Home / গল্প / এখন ওকে ঘুমোতে দাও, শান্তিতে – নির্মাল্য ঘরামী

এখন ওকে ঘুমোতে দাও, শান্তিতে – নির্মাল্য ঘরামী

Nirmalya gharami
চিত্র সৌজন্যঃ মেটা AI

 

 

আমি কেয়াকে ডাকলাম, -শোনো একটু, কথা আছে।

-আরেকটু বসতে দাও। কেয়া ভারী গলায় বলল, -একটু সবে মেয়েটার পাশে বসেছি।

“ঠিক আছে, থাকো।“ আমি মনে মনে বললাম, -আর কতক্ষণই বা! না হয় আরেকটু বসুক ও।

 

কিছুক্ষণ পরে কেয়া উঠে আমার কাছে এল। আমার পাশে বসে বলল, -জানো, ও ঘুমের ঘোরে বেশ অনেকবার তোমাকে-আমাকে ডাকল।

স্বাভাবিক! কিন্তু কিই বা করব? পরিস্থিতি একটা সময় হাতের বাইরে চলে যায়। কিছুই করার থাকে না। অথচ সময় যখন অনুকূলে, আমরা তখন সময়ের, বাস্তবের মর্ম বুঝি না। অবহেলা করি কর্তব্যে।

-আর জানো? আমার দিকে ফিরে বলল, “ ও একবার তিয়ামাসি, তিয়ামাসি করে চেঁচিয়ে উঠেছিল?”

-তাই? তিয়া এখন আমাদের থেকে দূরে সরে গেছে। আপনি দুটো বোতলকে সমুদ্রে ভাসিয়ে দিন, সমুদ্রস্রোত একটাকে একদিকে নিয়ে যাবে, আরেকটাকে অন্যদিকে। কখনোই দুটি বোতল একজায়গায় পৌঁছয় না, পরীক্ষা করে দেখা গেছে। বাস্তবের চাহিদার ফলে নিকট সম্পর্কগুলিও দূরে চলে যায়, দূরের সম্পর্ক কাছের হয়, আবার হয়তো তারা দূরে চলে যায়। কাউকে দোষারোপ করা অর্থহীন।

 

(২)

তিয়া ছিল কেয়ার দূরসম্পর্কীয় আত্মীয়া। টাউনে এসে সে আমাদের সঙ্গেই থাকত, পাশেই কলেজে পড়াশুনো করত। ওর মা আর কেয়ার মায়ের মধ্যে ছিল ঘনিষ্ঠতার সম্পর্ক। ফলে কেয়া কিছুতেই তিয়াকে আর মেস-এ থাকতে দেয়নি। তিয়া ফাঁকা সময় পেলেই সারাক্ষণ পিয়াকে আদর-যত্ন করত। এই হয়তো ওকে চান করাচ্ছে,  জামা-কাপড় পরাচ্ছে আবার কখনো বা কোলে নিয়ে পার্ক থেকে ঘুরে আসছে। মোটকথা যতক্ষণ বাড়িতে থাকত, পিয়া ছাড়া ওর চলত না। এরপরে ইউনিভার্সিটি। ফলে ওর আসা ক্রমশ কমতে থাকল। তবুও এখানে এলে ও পিয়াকে বগলদাবা করেই ঘুরতে নিয়ে যেত, কখনো কাছছাড়া করত না। একবার পড়ে গিয়ে পিয়ার কপাল কেটে গিয়েছিল। সেটা দেখে পিয়ার চেয়ে ওই বেশি কেঁদে ফেলেছিল। ওর মন নিঃসন্দেহে খুব নরম। সেবারে মেঝেতে পড়া জলে পা হড়কে ও আচমকা পড়ে যাচ্ছিল। আমি দারুণ রিফ্লেক্সে ক্যাচ নেওয়ার মতন করে ওকে ধরে ফেলেছিলাম। সেদিন বুঝেছিলাম শুধু মন না, ওর অনেককিছুই নরম। আর ঘটনা্টি কেয়ার সামনেই ঘটেছিল! তারপরে তো………।

 

(৩)

-আমার দিদি আছে! কেয়া প্রায়শই আমাকে বলত, -বিপদে-আপদে ও ঠিক দেখবে, দেখে নিও।

কথাটা হয়তো মিথ্যে নয়, তবে নির্ঘাত পনেরো আনাই বাড়িয়ে বলা। কিন্তু সেটা তো আর কেয়াকে বলা যায় না, চেঁচিয়ে এখনই পাড়া মাথায় তুলবে। কয়েকটা দিন সংসারের শান্তি যাবে। তারপরেও মুখ সারাক্ষণ গোমড়া করে রাখবে। ফলে কিছু না বলাই ভালো। বাস্তবের চেয়ে বড় শিক্ষক আর কেউ না। বড়ই বাজেভাবে সে আমাদের শিক্ষা দিয়ে যায়। তখন চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না।

 

কেয়ার দিদি কচিবয়সে ছেলে পছন্দ করে বিয়েও করেছিল। কিন্তু শ্বশুরবাড়ি আর তাদের ঘরে তোলেনি। ফলে ফিরে আসতে হল বাপের বাড়িতেই। সেই থেকে সেখানেই সে স্বামীসহ গ্যাঁট হয়ে বসেছে। যত দিন যাচ্ছে, যত বাবা-মায়ের শরীর খারাপ হচ্ছে, ততই তার দিদির প্রতিপত্তি বাড়ছে। আর এখন আমার শ্বশুর-শাশুড়ি গত হওয়ার কল্যাণে তাকে আর পায় কে? এমনি যে বোনকে সে স্নেহ করে না, তা নয়। তবে আমাকে ওরা বেশ সমীহ করে চলে। আঁট-ঘাঁট আমার ভালই জানা আছে। কোন দেবতা কোন ফুলে সন্তুষ্ট, আমি জানি। লাইন-টাইন সব নখদর্পণে। সেইজন্যেই কেয়া তার দিদির কাছে আরো বেশি বেশি পাত্তা পায়। অন্তত সেইসময়ে পেত। তবে সবকিছুই সতত পরিবর্তনশীল।

 

(৪)

-জানো মা, পিয়া বলল, -সানোদাদুর বাড়িতে গেছিলাম, -দিদা কথাই বলল না। আমাকে দেখে অন্যঘরে চলে গেল। দাদু খালি গুটিকয়েক প্রশ্ন করল।

-তাই? কেয়া গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করল।

-হ্যাঁ! বাইরের ঘরে বসতে বলে চলে গেল, একবারও ভিতরে যেতে বলল না। আমি টুনা’র সঙ্গে দেখা করতে চাইলে, না করে দিল। বলল, ও এখন পড়ছে। অথচ আমি ভিতর থেকে ওর গলার আওয়াজ পাচ্ছিলাম। ও মোটেও পড়ছিল না।

-হুম! কেয়া চুপচাপ ছিল। এগুলোই হয়তো স্বাভাবিক।

-মনে হয় টুনাও এসে আমার সঙ্গে খেলতে চাইছিল। ভিতরের ঘর থেকে ওর গলার আওয়াজ পাচ্ছিলাম। মনে হল শুনে দিদা ওকে বকে দিল। তারপরে জোর করে দোতলায় পাঠিয়ে দিল।

-আমি তোকে ওদের ওখানে যেতে বলেছিলাম? কেয়া ঠাণ্ডাগলায় জানতে চাইল।

-অন্যবারে গেলে কত আদর যত্ন করে ওরা। কত কিছু খাওয়ায়। টুনার সঙ্গে কতক্ষণ ধরে খেলি। এবারে দাদু কিছু কথা বলেই বেলা হয়ে যাচ্ছে বলে আমাকে বাড়ি চলে যেতে বলল।

স্বাভাবিক। আমি মনে মনে ভাবলাম। এটা ঠিক যে একসময়ে সানোদাদুদের বাড়ি যেখানে, সেটা নিয়ে কাগজপত্রের সমস্যা ছিল। ওরা ওই জমির এক শরিককে কিছু অ্যাডভান্স দিয়ে মৌখিক সম্মতি নিয়ে সেখানে বসবাস করছিল। আমার চ্যানেল খাটিয়ে আমি সেটা পরে ঠিক ম্যানেজ করে দিয়েছিলাম। বাস্তবে জমিটা যাদের ছিল, তাদের থেকে চেন ডীড-এর কপি এনে, চাপ দিয়ে দানপত্র করিয়ে, স্থানীয় কাউন্সিলরের সাকসেশন সার্টিফিকেট বের করে, সেটলমেন্টে কথা বলে, তাদের একজন উত্তরসূরীর মৃত্যুর বিষয়টা স্রেফ চেপে গিয়ে ওদের বিষয়টা সেটল করে দিয়েছিলাম। তবে এখন আমার অনুপস্থিতি প্রকট। ফলে এর বেশি পিয়ার আর কিই বা পাওয়ার ছিল? কেয়াই বা ওকে কেন ওদের বাড়ি যেতে দিল?  সম্পর্ক থেকে চিরতরে বেরিয়ে আসার আগে আমি ওদের একটা হিল্লে করেই এসেছিলাম। খুব ভালো না হলেও বাকি জীবন কেয়া-পিয়ার অনায়াসেই চলে যাবে, তবে খেয়াল রাখতে হবে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ জল তুললে অচিরেই টিউবওয়েল শুকিয়ে যেতে পারে। সেটা মাথায় রাখা উচিত। কাউকে আপনার সম্পর্কে বেশি জানতে দেবেন না। মেঘের আড়ালে না থাকতে পেরেই ইন্দ্রজিতের পতন হয়েছিল। তবে সাধারণ পাবলিকের যেমন সঠিক অর্থে আর্থিক জ্ঞান-গম্যি থাকে না, তেমনি আত্মীস্বজনদের ব্যাপারে আমাদের বোধ প্রায়শই যথেষ্ট নয়।

 

(৫)

-কেমন আছিস তিয়া? বাধ্য হয়ে আমি আজ ওকে ফোন করেই ফেললাম। ওর উপরে একসময়ে আমার কিছু আস্থা ছিল। কিন্তু…।

-কেমন আছ তুমি? অনিচ্ছার সুরে উত্তর দিল ও।

-এই, তোদের থেকে কিছুটা দূরেই চলে গেছি। তুই তো জানিসই।

-সেটাই তো স্বাভাবিক। বিজ্ঞ বিজ্ঞ গলায় সেদিনের সেই যুবতী মেয়েটি আজ পোড়খাওয়া গলায় বলল, -তুমি যদি ওই স্ক্যামের চক্করে না পড়তে! যদি চলে না যেতে। আমরা একসাথেই থাকতে পারতাম।

-তাই? পুরোনো দিনের মজা-ঠাট্টার আভাস কি পাওয়া গিয়েছিল আমার কণ্ঠস্বরে?

-মানে বলতে চাইছি কাছাকাছিই। তুমি সাপোর্ট দিতে। তোমাকে সেন্টার করেই আমরা থাকতাম, যেমন আগে ছিলাম। সময়ে-অসময়ে দেখা হত, কথা হত, সবাই সবাইকে দেখতাম। সকলের জন্যেই সেটা ভালো হত।

নিজের কথাটা ঠিকই ভেবে রেখেছে ও। কাছাকাছি থাকলে সাপোর্ট অবশ্যই দিতাম। কিন্তু আমার অবর্তমানে এবং বিশেষত বিয়ের পরে আর সে পিয়ার কথা ভাববে কেন, যেখানে আর্থিকভাবে তিয়া যখন খুব বেশি স্বাবলম্বী নয়, কিছু ছাত্র-ছাত্রী পড়িয়ে সামান্য রোজগার করে। আর তাকেও তো নিজের সংসার দেখতে হবে?

-তোর দিদি কেয়ার কথা মনে পড়ে?

-মাঝে, মাঝে। কাজের ফাঁকে।

বুঝলাম কেয়াকে সে মন থেকে বের করে দিয়েছে। স্বাভাবিক। সব জিনিসেরই একটা এক্সপায়ারি পিরিয়ড থাকে।

-পিয়ার কথা মনে পড়ে তোর? আমি আচমকা প্রশ্নটা করেই বসলাম।

-আমি তো ওর বাবা-মা নই। একেবারে পরিপক্ক গলায় তিয়া বলে চলল, -তোমাদের যতটুকু মনে পড়ে, তার চেয়ে কিছুটা কম হলেও মনে পড়ে দাদা।

এই তিয়া সেই তিয়া নয়, এ আমি নিশ্চিত। কেটে গেছে অনেকগুলি বছর। তিস্তা দিয়ে বয়ে গেছে অনেকই জল। যে সুর কেটে গেছে, তা আর বাজবে না। আমি আর দেরি করলাম না। আস্তে করে ফোনটা কেটে দিলাম।

 

(৬)

-দিদি, আমি বললাম, “কেমন আছ? টনি ভালো আছে?”

-এই দেখ না ভাই, কোনরকমে চলে যাচ্ছে। দিদি বিরস বদনে বললে। সেটাই স্বাভাবিক। তার ছেলেটি অর্থাত টনি একেবারে রকবাজ। আগের মতন পাড়ার রকের আড্ডাটা এখন আর নেই। তবে সেটা পুষিয়ে নেয় উল্টো-পাল্টা ছেলেদের সঙ্গে মিশে। ওকে সেবারে পুলিশি হেফাজত থেকে ছাড়িয়ে আনতে দিদিকে অনেক গুনাগার দিতে হয়েছিল। কমবয়সে পা হড়কে বিয়ে করলেও দিদি ভীষণই বৈষয়িক। অথবা হয়তো সেই অভিজ্ঞতার ঠোক্কর তাকে বাস্তবতার চরম পর্যায়ে উন্নীত করেছে। দিদি নেহাত এদিক সেদিক করে সামলে রেখেছে, নাহলে জামাইবাবুর সাধ্য ছিল না এভাবে টিকে থাকা। তবে আমাকে এখানে দেখে খুব যে খুশী হয় নি, সেটা পরিষ্কার। আর হওয়ার কথাও নয়।

-শরীর ভালো তো দিদি?

-আছি একরকম ভাই। পায়ের ব্যথাটা আবার চাগাড় দিয়ে উঠছে রাতবিরেতে।

স্বাভাবিক! কেয়ার অনুপস্থিতিতে দিদিকেই সব দেখতে হচ্ছিল। সেই সময়ে অনেক ছোটাছুটি করে আমাদের সব সম্পত্তি সামলেছে, অবশ্যই নিজের জন্যে, নিজের নিষ্কর্মা স্বামীর জন্যে। এবং তার বখাটে ছেলের জন্যও বটে! একটা অফিসে যেতে গিয়ে সেবারে দিদির দেরি হয়ে গিয়েছিল। তাড়াহুড়ো করে টোটো থেকে নামতে গিয়ে পড়ে গিয়ে ডান হাঁটুতে ভালই চোট পেয়েছিল। এসব চোট যায় না। অন্যকে চোট দিতে গেলে বা দিয়ে থাকলে নিজেকে চোট পেতেই হয়! কয়েকদিনের জ্বরে ভুগে কেয়ার হঠাত চলে যাওয়ার পরে পিয়ার গার্জেন বলতে তখন দিদিই সব। তবে কিনা……।

 

(৭)

-চলে এসো। আমি কেয়াকে বললাম, -ভোর হচ্ছে। এবারে আমাদের যেতে হবে।

-আর একবার পিয়াকে দেখে আসি। তুমিও চলো।

বলে আমাকে সঙ্গে নিয়ে ও অনাথ আশ্রমের কমবয়সী মেয়েদের সেকশনে এল। সারি সারি লোহার খাটের মধ্যে দিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম পিয়ার খাটের দিকে। কিছুটা অপরিষ্কার জায়গায় এখানে সেখানে বাচ্চারা তাদের খেলার জিনিস, জামা-কাপড়, খাওয়ার এঁটো থালা-বাটি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে। আমরা সেসবের মধ্যে দিয়ে গিয়ে পিয়ার খাটের কাছে চলে এলাম।

-দেখো, কেয়া প্রায় চেঁচিয়েই উঠল, -কি সুন্দর, পবিত্র ওর ঘুম। শান্তিতে ঘুমোচ্ছে আমাদের মেয়ে!

=====*****=====

Leave a comment

Check Also

মিলনের পরে

মিলনের পরে – নির্মাল্য ঘরামী

    সেই ঘরটির দিকে যেতে যেতে অমিয়বাবুর আজ মনে পড়ে যাচ্ছিল সৌরীনের কথাগুলো, -একজন …

স্বীকারোক্তি

স্বীকারোক্তি- ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য্য

    আজই ফোনটা ডেলিভারি দিয়ে গেলো। অনলাইনে একবার দেখেই ভারি পছন্দ হয়ে গেছিল সমীর …

দর্পণে

দর্পণে – নির্মাল্য ঘরামী    

    -চল, আমি জোরের সঙ্গে বললাম, -ওসব একদম ভাবিস না। তোকে এতদিন পরে পাচ্ছি, …

ফয়সালা

ফয়সালা – নির্মাল্য ঘরামী

  -দেখুন স্যার। বলে সিকিউরিটি গার্ডটি বিজয়ীর দৃষ্টিতে মহাকুলসাহেবের দিকে তাকালো। তার হাতে ধরা ব্যাগটির …