Home / রম্যরচনা / চলো মন নিজ নিকেতনে – বুদ্ধদেব চট্টোপাধ্যায়

চলো মন নিজ নিকেতনে – বুদ্ধদেব চট্টোপাধ্যায়

বুদ্ধদেব চট্টোপাধ্যায়
শিল্পী- পুণ্যতোয়া ধর

 

সক্কাল বেলা ৷ বেগটা বেশ চাগাড় দিয়ে উঠেছে। গামছার ফুটোটা ম্যানেজ করে নো ম্যানস ল্যাণ্ডে চালান করার চেষ্টা চালাচ্ছি ঠিক এই রকম সময়ে মোবাইলটা বেজে উঠল। অসময়ে ফোন, বেগ চেপে ধরে হ্যালো করলাম । ওপাশ থেকে বিদেশী কণ্ঠে প্রশ্ন, “ইস্‌ দিস্ গ্র্যাম ঘ্রৌ স্পিকিং ? ঘ্র্যাম ঘ্রৌ?!” যুগপৎ প্রশ্ন এবং বিস্ময় । পেছনের ইয়ে মাথার তালুতে উঠে গেল। সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়ল আমার বিদেশী লেখক অধ্যাপক বন্ধুরা তো আমাকে গ্র্যাম বলেই ডাকে। ওরা গুঁইরাম উচ্চারণ করতে পারেনা । ঘোড়ুই-ও না। তাই গ্র্যাম ঘ্রৌ। আমি বললাম, “ইয়েস স্পিকিং বাট আ্যাম ইন আ হারি।” তাড়াহারি, সরি তাড়াহুড়ো করে সেই বিদেশী বন্ধুটি একটি সংবাদ দিল। আমি সংবাদটা জাস্ট রিসিভ করেই কুললি বললাম- “অখ্যে, আই’ল টেক্সট মাই আনসার টেন মিসিট্‌স লেইটার।”

এই বলে ফোনটা রেখে দিয়েই ধাবিত হলাম বিমুক্তি কক্ষের দিকে। দিনের গুরুত্বপূর্ণ কাজটা সমাধা করে দেহে মনে কিঞ্চিৎ লঘুত্ব এনে হালকা করে একটা টেক্সট্‌ সেণ্ড করলাম সুইডিস নোবেল কমিটিকে, “থ্যাঙ্কস্‌, বাট আই হাম্বলি রিফিউজ টু আ্যাক্সেপ্ট দ্যা আ্যাওয়ার্ড ফর আই ফিল মাইসেল্ফ নট ওয়ার্দি অফ দিস্‌ প্রেস্টিজিয়াস আ্যাওয়ার্ড।”

ব্যাপারটা কিছুই না। ওরা ২০২৩ – এর সাহিত্যে নোবেলটা আমাকে দিতে চায় । আমি রিফিউজ করলাম ৷ কারণ আমি তো সত্যি সত্যিই নিজেকে যোগ্য মনে করি না। আ্যা-আ্যাই, এখানেই আমি। বিনয়কে যে সত্যিকারের ভূষণ করেছে। চেয়ে দ্যাখ্‌ তোরা বিনয় কাক্‌কে বলে!

তাছাড়া নোবেল প্রাইজ মানে বিস্তর হ্যাপাও বটে। শুধু সুইডেন থেকে প্রাইজটা নিলাম তা হলেই ত’ হল না। চারিদিকে বক্তিমে করে বেড়াতে হবে। আজ অক্সফোর্ড, কাল হার্ভার্ড, আ্যাক্কেরে Zআ তা। রবিবাবুর কেমন হয়েছিল মনে নেই? কুকুরের লেজে টিন বাঁধার আবস্থা।

যাক্‌ সে কথা। কাল মাঝরাত থেকে বউ খেপে আছে। যা-তা গালাগাল । অকর্মা, হিজড়ে কিছুই বলতে বাকি নেই, জীবনটায় কোন শান্তি নেই জানেন ? কোন আনন্দ নেই, কত জায়গায় আনন্দ, বাঁকুড়ায় আনন্দ, ডানকুনিতে আনন্দ, বারাসাতে আনন্দ, দুর্গাপুরে আনন্দ। আনন্দ পাবলিশার্সকে বলব আমার ঘরেও একটা বিপণি উন্মোচন করুন না। (উন্মোচন’টা কী আর্ষ প্রয়োগ হয়ে গেল?) এ্যাট্ লিস্ট বিজ্ঞাপনে তো দেখতে পাব- “এবার গুঁইরামের বাড়িতেও আনন্দ”।

জীবনটা টোটাল কেরোসিন । স্ত্রী বড়লোকের মেয়ে। মাধ্যমিকে দু-দুবার বসার অভিজ্ঞতা আছে। পরীক্ষকরা নাকি বদমাইশি করে পাস করায় নি। আমার মতো মাছিমারা কেরানীর ঘরে অর্থসুখ নেই। আমি চিররুগ্ন এবং জন্ম খিট্‌খিটে। স্ত্রীর শারীরিক, মানসিক কোন তৃপ্তিসাধনই হয়না। স্ত্রীকে একটা রিকেটি ছেলে ছাড়া কিছুই দিতে পারিনি। কাজেই, আমার সংসার কৃষ্ণহীন কুরুক্ষেত্র। এর থেকে একটু বাঁচার জন্যই নিজের বিশ্বরূপ দর্শন। চলো মন নিজ নিকেতনে। কখনো বা স্বামী বিবেকানন্দর মতো বক্তৃতা দিয়ে পৃথিবী কাঁপাচ্ছি। কখনো বা সার্ত্রর মতো নোবেল প্রাইজ প্রত্যাখ্যান করছি। কখনো মানিকদা, মৃণালদের মতো তাক লাগানো থটফুল সিনেমা করছি। আমার নিকেতনে আমিই রাজা৷ চৌকি আমার সিংহাসন। আমার সুপ্ত প্রতিভার আলোকজ্জ্বল কিরণমালা দেখে স্তম্ভিত আমার প্রাণপ্রিয় কলিগ নিবেদিতা। ওর কাছে হাততালি পাবার জন্য আমি দু-দুবার মাঘের শীতে এভারেস্টে চড়েছি। সারা দিনই এই সুন্দর স্বপ্নের জগৎটায় থাকি। সংসারের কাজে ভুল হয়। গিন্নীর কাছে গাল খাই। মুদির দোকান থেকে নিরমা আনতে গিয়ে নুন এনে ফেলি। দুটোই জলে দ্রব। একটা ফেনা হয়, অন্যটা গুলে যায়। গিন্নীর আবার ফেনা হওয়াটাই চাই।

অফিসে বসের কাছেও ধাতানি খাই। ভুলোমনা স্বভাবটা বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, অধ্যাপকদের মানিয়ে যায় কিন্তু একজন কেরানীর পক্ষে এটা ক্ষমাহীন অপরাধ। কিন্তু যে কথাটা  আমি বোঝাতে পারিনা সেটা হচ্ছে আমি তো আসলে একজন দার্শনিকই৷ কেরানীর এক্সটিরিয়ারের অন্তরালে দর্শনের ফল্নুধারা বয়ে চলেছে তিরতির করে। আসলে ওরা জানেনা আমি কী জিনিস! আমি কী বিপুল, কী বিশাল তা মাপ করার সাধ্য না আছে আমার মাধ্যমিক ফেল স্ত্রীর, না আছে ওপর চালাক সহকর্মী গুলোর। ওদের দোষ দিই না। নুনের পুতুল ওরা, সমুদ্দুর মাপবে কী করে? সবকিছু জেনেই আমি যীশুর মতো সবাইকে ক্ষমাই করে দিই- ঈশ্বর, এরা জানে না। কিন্তু কখন রাগ লাগে জানেন ? যখন আমার স্ত্রী আমাকে আমার ভায়রার সাথে তুলনা করে। বলে, “দেকেচো, কী এস্মাট, কড়ি কপালে পুরুষ।”

ভায়রাভাইটি সলমন রুশদি টাইপের দেখতে, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, গোলচশমা, ফর্সা, চকচকে টাক, ট্রাকসুট পরে সকালে জগিং-এ যায়। স্লিপিং স্যুট পরে ঘুমোয়। সন্ধের পর হালকা মদ্যপান। জমিয়ে সিগারেট খায়। লিভিংরুমের ক্যাবিনেটে তালাবন্ধ সারি সারি বই। হাতের মলিন স্পর্শ লাগেনি। মুখে বড় বড় কথা বলে আঁতেল সাজতে চায়। আমার হাইটে উঠতে গেলে তোকে কয়েকটা জন্ম ট্রায়াল দিয়ে আসতে হবে। ফুঃ! বাপের জন্যে মিলান কুন্দেরার নাম শুনেছিস? আধুনিক কবিতা বুঝিস্‌ ? আমার একটা কবিতার মানে করে দে তো দেখি ? টেকোমাথায় বাকী চুলগুলোও উঠে যাবে । আমি নিজেই নিজের কবিতাগুলো ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বার পড়েও বুঝতে পারিনা। কিন্তু আমার যে কপালে কড়ি নেই, ট্রাকসুট পরিনা। খসটে লুঙ্গি পরি । অফিস থেকে ফিরে তেল মেখে মুড়ি খাই। গায়ে সর্ষের তেল মাখি। প্রতিদিন দাড়ি কামাই না, বুট জুতো পরি না; পেটাতরের গন্ধে লোকে নাকে রুমাল চাপা দেয় । আমাকে কেন নিবেদিতা ভালবাসতে যাবে বলুন?

এগুলো যখন ভাবি না, গা-টা কেমন শিরশির করে ওঠে। গায়ে কাঁটা দেয়। গলার কাছে কথাগুলো দলা পাকিয়ে যায়। চোখ ঠেলে অশ্রু বেরিয়ে আসতে চায়। তখন খুব ভালো লাগে জানেন। কেমন একটা নেশার মতো লাগে। তখন পালাই | নিজ নিকেতনে। সেখানে তখন আমি হিন্দি সিনেমার হিরো । ভায়রা কে ভিলেন বানিয়ে বে-দম প্রহার দিই। আমার রিকেটি ছেলেটা হাততালি দিয়ে ওঠে । আমি ওকে ভিক্ট্রি সাইন দেখাই। এসব ভাবতে ভাবতেই নিরমা আনতে গিয়ে নুন নিয়ে আসি । দুটোই জলে দ্রব। একটা একেবারে গুলে যায়, অন্যটা ফেনা হয়।

 

……০……

Leave a comment

Check Also

বাস

বাঁশযাত্রা- সোমক সেনগুপ্ত

  বাসস্টপে দাঁড়িয়ে আছি। ত্রাহি-ত্রাহি রবে একটা মানুষের স্তূপ এলো! কার কোনটা মাথা, কোনটা বডি …

সোমক সেনগুপ্ত

এনকাউন্টার – যশোবন্ত্‌  বসু

ব্রজকিশোর আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ব্রকজিশোর প্রত্যেক বছর আমাকে তার বাড়ির গাছের সজনেফুল আর কচি নিমপাতা …

পুরুষ গরু – রঘুনাথ মণ্ডল

সুবিমলবাবুর কর্মসূত্রে শহরে বাস। গ্রামের বাড়িতে পারিবারিক দুর্গাপুজো, তাই প্রতিবছর পুজোর সময় গ্রামের বাড়ি যান। …

স্মৃতি সততই শোকের – যশোব ন্ত্‌ বসু

ছবি – সোমক সেনগুপ্ত শেফালির বিয়ের কথাটা মনে পড়লেই নৃপেন্দ্রশেখরের মুখটা তেতো হয়ে যায়, মেজাজ …