Home / রম্যরচনা / সবার ঢঙে ঢঙ মেশাতে হবে ~ যশোবন্ত্ বসু

সবার ঢঙে ঢঙ মেশাতে হবে ~ যশোবন্ত্ বসু

sabar dhonge dhong meshate hobe
শিল্পী- পুণ্যতোয়া ধর

 

নবকান্ত নস্কর বাইরে বেরোলেই চোখেমুখে একপিস কৃত্রিম মিঠেপানা হাসি আলতো ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়ান। সবসময়। কারণ  নবকান্ত নস্কর সেলেব্রিটি  হয়ে গেছেন  !

 

এই সেদিন পর্যন্ত তিনি কেরানিগিরি করতেন।

সাইকেলে ডোরাকাটা নাইলনের থলি ঝুলিয়ে বাজারে যেতেন। ফিরে এসে গামছা পরে কলতলায় স্নান করে ভাত, ডাল, লাউ বা কুমড়োর তরকারি  খেয়ে আপিস যেতেন।

আপিসে কাজের চাপে তাঁর মাঝেমাঝেই ডিসপেপসিয়া হত। প্রেশার বেড়ে যেত, বাঁ চোখ নাচত।

ছাপোষা নবকান্ত এভাবেই দিব্য চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

 

কিন্তু একখানি স্মার্টফোন তাঁর সাধারণ  জীবনকে পুরো পালটে দিল।

 

সকালে ঘুম থেকে উঠে বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ব্রাশ করতে করতে হয়তো দেখলেন, গতকাল রাত্রে শুতে যাবার আগে গ্রিলের বারান্দার দড়িতে টাঙানো আগের দিনে স্নানের পর মেলে দেওয়া লুঙ্গি, জাঙিয়া তুলতে ভুলে গেছেন। সকালে সেই শুকনো পরিচ্ছদাদি দড়ি থেকে তুললেন। কিন্তু তার আগে ট্রাইপড নিয়ে এসে তাতে স্মার্টফোন ফিট করে টাইমার দিয়ে দড়ি থেকে শুকনো জাঙিয়া, লুঙ্গি তোলার ছবিটি নিয়ে রাখলেন। সেই ছবি যথাসময়ে পোস্ট হবে, ক্যাপশনে কী লিখবেন সেটাও সেই মুহূর্তে ঠিক করে রাখলেন : সাতসকালে বকেয়া লুঙ্গি উত্তোলন দিয়ে দিন শুরু হল !

 

বেলা দশটা নাগাদ অফিস যাবার জন্য রেডি হয়ে বেরিয়েছেন, এমন সময়ে পাশের বাড়ির দয়াময়বাবুর কলেজপড়ুয়া মেয়ে দময়ন্তী এল ওদের গাছের একগোছা সজনেডাঁটা দিতে। নবকান্ত হাত বাড়িয়ে ডাঁটা নিলেন বটে কিন্তু তার আগে তার ছবি তুলতে ভুললেন না। প্রাথমিক পর্যায়ে দময়ন্তী  প্রবল আপত্তি জানিয়েছিল, তার নাইটি-পরা ছবি সোশ্যাল ওয়ালে পোস্ট করা কিছুতেই চলবে না। নব তাকে বোঝালেন, আরে দূর বোকা মেয়ে, ছবিতে ওই নাইটি কি আর নাইটি থাকবে নাকি, ফোটোশপে তাকে চমৎকার ঝলমলে এক লহেঙ্গা করে দেওয়া হবে। ওপরে ক্যাপশন যাবে : সুজন প্রতিবেশীর সুন্দরী কন্যার হাত থেকে সজনেডাঁটা গ্রহণ।

 

এরপর, বলা বাহুল্য,  দময়ন্তীর আপত্তি আর ফ্রেমে টেকেনি।

 

অফিসে পৌঁছে দেখলেন, পাশের টেবিলের বনানীর এক মাসের সি সি এল শুরু হয়েছে। ফলত তার জিম্মায় থাকা প্রায় হাফ ডজন ফাইল অফিসের পিওন সুধাময় ওপরওয়ালার নির্দেশ মোতাবেক নবকান্তর টেবিলে সাজিয়ে রেখে গেছে। নবর মুখের ভেতরটা তেতো হয়ে গেল। কিন্তু সেই তেতো স্বাদ তো আর ছবিতে দেখানো যায় না। অগত্যা একটি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে নবকান্ত পাশাপাশি দুটি টেবিলের ছবি তুললেন। পোস্ট করার আগে লিখে দিলেন, কারও পৌষ মাস,  কারও সব্বোনাশ।

 

অফিস থেকে ফেরার পথে নবকান্ত একবার চোখের ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকলেন। কদিন ধরেই ভাবছিলেন, চশমার পাওয়ার বোধহয় বদলাতে হবে। আগে থেকে নাম লেখানো ছিল না। অপেক্ষা দীর্ঘ হল। প্রায় ঘণ্টাখানেকের মতো। এই এক ঘণ্টাকাল তিনি অলস, নিষ্কর্মা হয়ে বসে থাকবেন, সে-শর্মা তিনি নন। সামনের সেন্টার টেবিলে বেশকিছু পত্রপত্রিকা রাখা ছিল। কিন্তু পড়াশোনার পাঠ চুকে যাবার পর আর কোনও বইপত্র ছুঁয়ে দেখেননি নব। বুক বলতে তিনি এখন ফেসবুককেই বোঝেন।

মাসটা নভেম্বর। চেম্বারের ভেতর সিলিংফ্যান দু’খানা বন্ধ আছে এবং ডাক্তার পালের চেম্বারে মশা আছে যথেষ্ট আর সেই মশককুল অপেক্ষারত রোগী বলতে শুধু নবকান্তকেই এখন বাগে পেয়েছে।  বাকি রুগিরা একে একে নির্দিষ্ট সময়ে বিদায় নিয়েছেন। ডাক্তারবাবুর ঘর থেকে সতেরো নম্বর রুগি নিষ্ক্রান্ত হলেই আঠারো নম্বর টোকেনধারী নবকান্ত প্রবেশ করবেন। তার আগের এই সময়টায় নব আত্মরক্ষার্থে  নিজের হাতে যতগুলি মশা মেরেছেন, সবকটির মৃতদেহ মেঝে থেকে এক-এক করে তুলে টেবিলে-রাখা একটি পত্রিকার ওপর জড়ো করলেন। সাকুল্যে সাঁইত্রিশটা। এরপর পকেট থেকে ফোন বের করে সাঁইত্রিশখানা মৃত মশার ছবি তুললেন। ছবির সঙ্গে লেখা পোস্ট করলেন :  মশামারা কেরানি। চোখ দেখাতে এসে  রক্তদান করে ফিরছি।

 

এইভাবে নবকান্ত নস্কর তাঁর ভবলীলার প্রায় প্রতিটি অবিস্মরণীয় হিরণ্ময় মুহূর্তকে ক্যামেরাবন্দি করে জনগণের ভার্চুয়াল ভোজসভায় সুচারুভাবে পরিবেশন করার নেশায় সবিশেষ পারদর্শী হয়ে উঠলেন।  তার পাশাপাশি তিনি প্রায় নিত্যি দিন তাঁর দাড়ি কামানো, দাড়ি না-কামানো নানা ভঙ্গিমার মুখচ্ছবিও সোশ্যাল উঠোনে পোস্ট করতে লাগলেন। এছাড়া কুয়ো থেকে জলতোলা, ভাত খেয়ে উঠে মুখধোওয়া কিংবা গান-কবিতা-চণ্ডীপাঠ-কপালভাতি-অনুলোমবিলোমের Live উপাচার তো আছেই।

 

ব্যস, নবকান্তর ভার্চুয়াল বাজার ক্রমশ  জমে উঠল !

ফেসবুকের ‘What is on your mind’ আউট অব নাথিং নবকান্ত নস্করকে রীতিমতো সেলেব্রিটি বানিয়ে ছাড়ল !

শেষে ব্যাপারটা এমন দাঁড়াল, নবকান্ত আর ফোন ছেড়ে বেঁচে থাকার কথা ভাবতেই পারেন না। ফোনের সঙ্গেই তাঁর যাবতীয় ফ্যান্টাসি ও স্বগতকথন :

“ম্যায় অউর মেরি Phone-screen অকসর ইয়ে বাতে করতে হ্যায়, তুম হোতি তো অ্যায়সা হোতা, তুম ইয়ে কহতি, তুম ও কহতি, তুম ইস বাত পে হ্যায়রাঁ হোতি, তুম ইস বাত পে কিতনা হাসতি, তুম হোতি তো অ্যায়সা হোতা, তুম হোতি তো অয়সা হোতা, ম্যায় অউর মেরি Phone-screen অকসর ইয়ে বাতে করতে হ্যায়।”

 

নিজের এপিটাফও তাঁর আগাম লেখা হয়ে গেছে :

 

“এ Phone-লোক মধুময়, মধুময় আত্মরতির ধূলি–

সযতনে মেখেছে অঙ্গুলি

 

এই Netমন্ত্রখানি,

 

চরিতার্থ জীবনের বাণী।

 

দিনে দিনে পাইতেছি লাইক-কমেন্টের যা-কিছু উপহার

 

মধুরসে ক্ষয় নাই তার।

 

তাই এই আত্মরতির বাণী আশিরনখ বাজে–

 

সব লাইক নিখাদ ভাবি অনন্তের আনন্দ বিরাজে।

 

Virtual স্পর্শ নিয়ে যাব যবে ধরণীর

 

ব’লে যাব সাক্ষাৎ Celebrity-র

 

তিলক পরেছি ভালে,

 

শুনি নাই লোকে হাসে Phone-এর আড়ালে।

 

মিথ্যার আনন্দরূপ এই Screen-এ নিয়েছে মুরতি,

 

তাহারে সত্য জেনে নিজ পায়ে রাখিনু প্রণতি।”

 

 

এমন নবকান্তদের ভার্চুয়াল ভান্ডার  থাকুক ভরে আপলোডে থরেবিথরে !

আমাদের এই নবকান্ত নস্করের মনের কোণে শুধু একটাই উচ্চাশা আর  একটাই দুঃখ নাছোড় সেঁটে আছে ।

উচ্চাশাখানি এই , কোনও একবার তিনি ভোটে দাঁড়াবেন।

আর হতাশাটি হল, রাস্তাঘাটে এখনও পর্যন্ত কেউ তাঁর অটোগ্রাফ চাইল না।

 

ভার্চুয়ালে যতই সৌজন্য বিতরিত হোক, অ্যাকচুয়াল মানুষ তবে প্রকৃত প্রস্তাবে সত্যিই বড়ো পরশ্রীকাতর !

 

……০……

 

Leave a comment

Check Also

বাস

বাঁশযাত্রা- সোমক সেনগুপ্ত

  বাসস্টপে দাঁড়িয়ে আছি। ত্রাহি-ত্রাহি রবে একটা মানুষের স্তূপ এলো! কার কোনটা মাথা, কোনটা বডি …

সোমক সেনগুপ্ত

এনকাউন্টার – যশোবন্ত্‌  বসু

ব্রজকিশোর আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ব্রকজিশোর প্রত্যেক বছর আমাকে তার বাড়ির গাছের সজনেফুল আর কচি নিমপাতা …

পুরুষ গরু – রঘুনাথ মণ্ডল

সুবিমলবাবুর কর্মসূত্রে শহরে বাস। গ্রামের বাড়িতে পারিবারিক দুর্গাপুজো, তাই প্রতিবছর পুজোর সময় গ্রামের বাড়ি যান। …

স্মৃতি সততই শোকের – যশোব ন্ত্‌ বসু

ছবি – সোমক সেনগুপ্ত শেফালির বিয়ের কথাটা মনে পড়লেই নৃপেন্দ্রশেখরের মুখটা তেতো হয়ে যায়, মেজাজ …