Home / বাঘু সিরিজ / কদলীপ্যাথি চিকিৎসাধীন বাঘু – মৌসুমী পাত্র

কদলীপ্যাথি চিকিৎসাধীন বাঘু – মৌসুমী পাত্র

কদলীপ্যাথি চিকিৎসাধীন বাঘু
শিল্পী- গুঞ্জা

 

          বিচ্ছিরি গরম পড়েছে! একেবারে বাঘিপিসী-মার্কা! বাঘুর অন্ততঃ তাই-ই মনে হচ্ছে! বাঘিপিসী যেমন সব সময় ফুটছে তো ফুটছেই, কিসে যে উনি খুশি হবেন বোঝাই দায়- আগুন ঝরিয়ে যাচ্ছেন তো ঝরিয়েই যাচ্ছেন! আকাশের সূর্যস্যারও হয়েছেন তেমনই, মাথা গরম করে বসে আছেন তো বসেই আছেন! সেই সন্ধেবেলা হলে তাঁর নাকে তেল দিয়ে ঘুমোতে যাবার সময় ঠাণ্ডা হবেন। চাঁদমিসকে দেখেও তো শেখা যায়, না কি? চাঁদমিস কী সুন্দর নরম নরম শান্ত লাজুক, মিষ্টি মিষ্টি হাসেন- কী করে যে সূর্যস্যারের সঙ্গে একই আকাশে থাকেন, কে জানে?

          সামনে অঙ্কের বইখানা খুলে বিভোর হয়ে এসব গুরুতর চিন্তাভাবনা করছিল বাঘু। ‘অঙ্ক আবেশ’ বইটা শেষ হয়ে নতুন অঙ্কের বই শুরু করেছেন দিদিমণি- ‘গণিত গ্রন্থি’। গোড়া থেকেই এই বইটাকে মোটে পছন্দ হয়নি বাঘুর। আর নামেরই বা কী ছিরি- গণিত গ্রন্থি! আহা! যেন শেকল দিয়ে কুমড়ো বাঁধা! গ্রন্থি মানে তো গিঁট! বোঝাই যাচ্ছে, এই বইখানা গিঁটের পর গিঁট লাগিয়ে তাদের জেরবার করে দেবে!

          ‘অঙ্ক আবেশ’ বইটাকে বেশ ভালো লাগত বাঘুর। হাতে নিয়েই দিব্যি ঘুমের একটা আবেশ চলে আসত! এই নিয়ে দিদিমণির কাছে আবদারও করতে গিয়েছিল বাঘু, “দিদিমণি, বইটার নাম একটু বদলে দিন না! ধরুন, বইটার নাম দিলেন, ‘গণিত গামলা’! তাহলে আমাদেরও এই গরমে গামলায় চান করার মত আরাম- আরাম লাগবে আর টপাটপ সব অঙ্ক কষে ফেলব!”

          কুমরু ছিল পাশেই। সে ভেঙিয়ে উঠেছিল, “কিংবা গণিত কলকম্বল!”

          হিনিমিনিও মুখ বাঁকাল, “গলকম্বল? তোর তো ওই বুদ্ধিই সম্বল! তার চে’ দিদিমণি, আপনি নাম রাখুন ‘গণিত গুমটি’, মজা হবে জমজমাটি। আমি ওই গুমটিতে বসে রথ দেখব, কলা বেচব!”

          তুবড়ির মতো ফেটে পড়েছিল শিয়ালনি, “থামবি সব? নইলে বইয়ের নাম দেব ‘গণিত গলাধাক্কা’, আর অঙ্ক করাব দু’ঘন্টা পাক্কা!”

           এর ওপর তো আর কথা চলে না। তাই সবাই চুপ করে গিয়েছিল। খালি বাঘুই যা নিজের মনে গজগজ করেছিল, “আমি দুটো ভালো কথা বলতে গেলেও দোষ! কোনও বাক্‌স্বাধীনতা নেই!”

 

          তা সে যাই হোক, এখন উপস্থিত বাঘু পড়েছে মহা ঝামেলায়। কাল রাতে নাটক দেখতে গিয়েছিল বাঘু। পশু প্রান্তরে নাটকের আসর বসেছে তিন দিনের। কালকের নাটক ছিল- ‘রথের কলা, ভুলের জ্বালা’। আর তার আগের দু’দিন নাটক ছিল ‘কাকের কালি, কুমড়োর ফালি’ আর ‘কুমীরের গায়ে কাঁটা, সজারুর লেজে ঝাঁটা’।

          প্রথম দু-দিন যাত্রা দেখতে যেতে পারেনি বাঘু। যাবেই বা কিভাবে? ইয়া ইয়া ইয়েতি-মার্কা এক একখানা যা অঙ্ক দিয়েছিলেন না দিদিমণি! সে সব অঙ্কের বিকট সব গ্রন্থি ছাড়াতে ছাড়াতেই বাঘুর যাচ্ছেতাই দশা। মাঝখান থেকে অঙ্কের গিঁট খোলার বদলে আরও ঘোরতর পাকিয়ে উঠল, আর দিদিমণি এসে বাঘুকে একশ-টা লেজফি শাস্তি দিলেন!

          লেজফি শুনে বাঘু ঘাবড়েই গিয়েছিল কিছুটা। হাতুশি শুঁড় দোলাতে দোলাতে বুঝিয়েছিল, “ওরে বাঘু, এইটা বুঝলি না? মানুষেরা আজকাল মোবাইল ফোন ব্যবহার করে, জানিস তো! সেই যে সিংহালু বলেছিল না! তা সেই মোবাইল ফোন দিয়ে মানুষেরা যখন নিজেরা নিজেদের ছবি তোলে, তাকে বলে সেলফি। তার মানে, নিজেই নিজের লেজমলাকে বলে লেজফি। এই তো, সোজা ব্যাপার!”, এই বলে হাতুশি শুঁড় ওল্টানোর ভঙ্গি করেছিল!

          সেই লেজফি-র ভয়েই বাঘু এখন বসে বসে অঙ্কের জট ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। কী বদখত অঙ্ক রে বাবা! প্রশ্ন দিয়েছে- একটি বিটকেল বাঘের লেজে মোট ১৭টি গিঁট পড়েছে। বাঘটির লেজের গিঁটবিহীন অংশের দৈর্ঘ্য ৩৭ সেন্টিমিটার। যদি বাঘটির প্রতিটি গিঁটের দৈর্ঘ্যই সমান হয় এবং বাঘটির লেজের মোট দৈর্ঘ্য ১০০ সেন্টিমিটার হয়, তাহলে প্রতিটি গিঁটের দৈর্ঘ্য কত?

          অঙ্কের চোটে বাঘুর লেজ ঘেমেনেয়ে একশা। দুরুদুরু বুকে নিজের লেজে বারকয়েক হাত বোলাল। কে জানে, অঙ্ক করতে গিয়ে যদি তার লেজেই খানকতক গিঁট পড়ে যায়! কুমরু ওদিকে নিজের মনে অঙ্ক করছে আর গুনগুন করে গান গাইছে-

রথে চড়তে গিয়ে আমি

আছাড় খেলুম রে…

মুখোশ পরে ভেংচি কাটতে

ভুলে গেলুম রে…

ও জেঠি রে, ও পিসি রে…

 

গালে পাউডার ঘষতে গিয়ে

ভাতের ফ্যান মাখি,

মনের ভুলে, ও দাদু রে…

চানের সময় গায়ে আমি

বালি ঢালি রে…

মনের ভুলে… ও মেসো রে…

পায়ে জুতো পরতে গিয়ে

লেজে বাঁধি রে…

মনের ভুলে… ও মামী রে…

 

কুমরুর গান দিব্যি গড়গড়িয়ে চলছিল। শিয়ালনি ওদিকে আপনমনে ঝিমুচ্ছে। অবশ্য শিয়ালনি এটাকে মোটেই ঝিমুনি বলে না, বলে ‘নিদিধ্যাসন’! মানে, একমনে ভাবনাচিন্তা করা।

 হাতুশি শুঁড়ে পেনসিল বাগিয়ে অনেকক্ষণ আগেই অঙ্ক শেষ করে এখন হিনিমিনির সঙ্গে কাটাকুটি খেলছে। হিনিমিনি নিজে নিজে অঙ্ক পারেনি, হাতুশির দেখে টুকেছে। ভালকি অবশ্য এসব সাতে পাঁচে থাকে না, সে মাঝে মাঝে আড়চোখে দিদিমণির দিকে চাইছে, আর ব্যাগ থেকে একটা টুথপেস্টের টিউব বের করে মাঝে মাঝে চাখছে।  

অকস্মাৎ একটা গোঁ গোঁ আওয়াজ আর তারপরেই ধপাস! বাঘু গেছে উলটে। হাতুশি ছুটে এসেছে শুঁড়ে পেনসিল বাগিয়ে, হিনিমিনির হাতে কাটাকুটি খেলার গাছের ডাল, কুমরুর থাবায় পেনসিলের খোসা, ভালকির হাতে ছিপি খোলা টুথপেস্টের টিউব! এমনকি শিয়ালনি দিদিমণি অবধি ‘নিদিধ্যাসন’ ভেঙে হাঁফাতে হাঁফাতে ছুটে এসেছেন।

ধরাধরি করে বাঘুকে তো তোলা হল। বাঘুর মুখচোখ কিরকম অদ্ভুত ধরনের বিকৃত হয়ে গেছে। মুখ দিয়ে সমানে গোঁ গোঁ আওয়াজ করছে। সব মিলিয়ে বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার! যদিও জংগলের এদিকটায় গাছগাছালির ছায়া আর বনের ঠাণ্ডা হাওয়ায় অনেকটাই মনোরম, তবুও, বাচ্চাটার লু লেগে গেল নাকি?

শিয়ালনি মহা উদ্বিগ্ন। হাতুশি মাথায় শুঁড় বোলাচ্ছে। ভালকির হাতে টুথপেস্ট ধরা দেখে শিয়ালনি কটমট করে চেয়ে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। কুমরু খুচ খুচ করে দু-চার ফোঁটা চোখের জল ফেলল। তারপর তাই দিয়েই বাঘুর চোখ মুখ মোছানোর প্রাণপণ প্রয়াস চালাল। হিনিমিনি সমানে ‘বাঘু, হ্যাঁ রে বাঘু, তোর কি লেজ ব্যথা না কি পেট ব্যথা? মাথা খারাপ নাকি ভুঁড়ি খারাপ? কদলী বটিকা খাবি? না রম্ভা রস দেবো?”, এই করেই যাচ্ছে সমানে।

শিয়ালনি কষে এক ধমক লাগাল, “থাম দেখি, তোরা সব। একটাও কথা বলবি না। বাঘু, এই বাঘু! কী হয়েছে রে?”

বিস্তর সাধ্যসাধনার পর বাঘু চোখ খুলল। এপাশ ওপাশ তাকাচ্ছে ফ্যালফ্যাল। তারপরই প্রশ্ন, “আপনারা সবাই কারা? এখানে এত বইখাতাই বা ছড়ানো কেন?”

শিয়ালনি ডুকরে কেঁদেই ফ্যালে আর কী, “বাঘু! বাঘুউউউ! তুই আমাকে চিনতে পারছিস না?”

বাঘু কেমন একটা দৃষ্টিতে তাকাল, “আপনি কে? চোখে চশমা কেন? লেজে ফুলই বা বাঁধা কেন? কেমন চেনা চেনা লাগছে!”

  তীব্র এক আর্তনাদ করে উঠল শিয়ালনি, “বাঘু! ওরে বাঘু রে এ এ এ! আমি শিয়ালনি দিদিমণি। চিনতে পারছিস না?”

বাঘু এপাশ ওপাশ মাথা নাড়ল, “বাঘু কে? বাঘুকে ডাকছেন কেন?”

সমবেত হাহাকারের একটা ঝড়ই উঠে গেল যেন। মনের দুঃখে হিনিমিনির লেজখানা দিয়েই চোখ মুছতে শুরু করে দিয়েছে শিয়ালনি, “ওরে বাঘু, তোর নামই বাঘু রে!”

“ও আচ্ছা, আমার নামই বাঘু!”, বলেই বাঘু চোখ মুজে ফের ধপাস!

বাঘু শুয়ে পড়ে আর চোখ খুলছেই না। হিনিমিনি চেঁচানি জুড়ল, “ওরে বাঘু, ঠিকঠাক কথা বল না রে! দেখতেই পাচ্ছিস, দিদিমণি আমার লেজটাকে রুমাল ভেবে নিয়েছেন!”

শিয়ালনিও সঙ্গে সঙ্গেই পালটা বিলাপ জুড়েছে, “ না না এটা ঠিক লেজ নেয়, এটা রুমালই। বাঘু যদি বাঘু না হয়, তাহলে এই লেজও হিনিমিনির লেজ নয়! এটা আমার রুমাল! ওরে বাঘু, বাঘু রে এ এ এ এ এ! তোর কী হল রে এ এ এ এ! এবারে তোর মা-কে আমি কী করে মুখ দেখাবো রে এ এ এ এ!”

কুমরুর মনে হল তারও কিঞ্চিৎ কান্নাকাটি করা দরকার। তাই সেও ফোঁপানি শুরু করল, “ওরে বাঘু রে এ এ এ! এরকম করলে কী হয় রে এ এ এ! আজ আমি তোর টিফিন চুরি করে খাবো ভেবে রেখেছিলাম রে এ এ এ! তার এবার কী হবে রে এ এ!”

হাতুশি এগিয়ে এল। তার মাথা ঠাণ্ডা। সে খুব শান্তভাবে বলল, “দিদিমণি, বাঘুর মা-কে একটা খবর দেওয়া দরকার। বাঘুর বাবা  সুন্দরবন থেকে মধু আনতে গেছেন শুনলাম। বাঘিপিসীকেও একটা খবর দিলে ভালো মনে হয়। বাঘিপিসী তো খুব বিবেচক, ভালো ব্যবস্থাপাতি করতে পারবেন।”

শিয়ালনি একটু ধাতস্থ হয়েছে এতক্ষণে। মাথা নেড়ে বলল, “সেই ভালো। ভালকি তুই গিয়ে বরং বাঘিন্নীদিদিকে ডেকে আন। আর হিনিমিনি, তুই যা। ডালে ডালে পাতায় পাতায় গিয়ে বাঘিদিদিকে খবর দিয়ে ডেকে আনবি।”

সহসাই বাঘু যেন খানিক কেঁপে ঝেঁপে নড়ে উঠল। আর তার একটু পরেই বাঘু উঠে বসল, “কী ব্যাপার, দিদিমণি? আপনারা সবাই এমন করে আছেন কেন? কী হয়েছে? আমি কি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম?”

শিয়ালনি হাঁফ ছেড়ে বাঁচল যেন, “হ্যাঁ রে বাঘু, তুই ঘুমিয়েই পড়েছিলি।”, বলেই চোখের ইশারা করল বাকি পশুয়াদের। বাঘুর সামনে কেউ যেন আর এ ব্যাপারে মুখ না খোলে।

বাঘু এদিকে দিব্যি খানিকক্ষণ সহজ সুরেই কথাবার্তা বলল। সবাই নিশ্চিন্ত। যাক্‌, বাঘুর অন্ততঃ বড়ো কিছু হয়নি। হয়তো ঘুমের ঘোরে বাজে স্বপ্ন দেখে ভুলভাল বকেছে।

সেই সময়ই বাঘু মুখ খুলল, “দিদিমণি, আপনার ওই ছাগলের কাঁঠালপাতা খাওয়ার অংকটা একবারটি বুঝিয়ে দেবেন?”

আবার সব কিছু গুবলেট হয়ে গেল সবার। ধীরে ধীরে দেখা গেল, বাঘু কিছু মনে রাখতে পারছে, কিছু পারছে না। বিশেষ করে পড়াশুনোর ব্যাপারে তো পুরো তালগোল করে ফেলছে।  দিদিমণি অঙ্ক করতে দিলে বাঘু পাতাভর্তি হাতের লেখা করে জমা দিচ্ছে, বিজ্ঞানের প্রশ্ন দিলে হাবিজাবি ছবি আঁকছে। আর কোন কিছুই প্রায় মনে রাখতে পারছে না।

বাঘিন্নীকে শিয়ালনি নরমসরম ভালোমানুষ, ইয়ে মানে ভালোবাঘ বলেই জেনে এসেছে এতকাল। সেই বাঘিন্নী পর্যন্ত একদিন পাঠশালায় এসে যাচ্ছেতাই করে বলে গেল শিয়ালনিকে। “দ্যাখো শিয়ালনি, তোমার ওপর ভরসা করে আমার অত শান্ত সুবোধ নরম ভদ্র ছানাকে পাঠিয়েছি পড়তে। কিন্তু তুমি বাপু বড্ডো চাপ দাও আমার ছানাকে। বাঘের বাচ্চা অত অংকটংক করে কী করবে বলো তো? মানুষের মতো তো চাকরিবাকরি করার দায় নেই। আমাদের জমি জায়গা আছে বিস্তর, চাষ করবে আর খাবে। আর তোমার ওই গণিত গ্রন্থির অঙ্ক তো নয়, যেন পেল্লায় সাইজের আমের আঁটি। আর তোমার বিজ্ঞানের পড়া তো নয়, আমার সুবোধ বাঘছানার মাথায় কাঁঠাল ভাঙা! এমনকি, তোমার বাংলা তো নয়, যেন মাথায় ভাদ্রমাসের তাল পড়া! …”

আরও কত কিছু বলে গিয়েছিল বাঘিন্নী। পাংচার হওয়া সাইকেলের টায়ারের মতোই চুপসে গিয়েছিল শিয়ালনি। পাঠশালার পশুয়ারাও চুপসে যাওয়া বেলুনের মতোই মুহ্যমান। একমাত্র বাঘুরই বিন্দুমাত্রও হেলদোল নেই। একটু আগেই টিফিন টাইমে বাঘু গিয়ে ভালকিকে গদাম করে এক ঘুঁষি মেরেছে। ভালকি যখন পালটা একটা ভালুক্সিং কি ভ্যালাটের প্যাঁচ ঝাড়বে ভাবছে, (মানুষের যেমন বক্সিং বা ক্যারাটে, ওদের তেমনই ভ্যালাক্সিং বা ভ্যালাটে। মানুষের দেওয়া নাম ওরা নেয় না কিনা!) তখনই বাঘু একগাল হাসিতে মুখ ভরিয়ে দিয়ে ভালকিকে বলেছে, “কাছুয়াদিদি, কাছুয়াদিদি, আমার কোন চিঠি আসেনি?”

এর পরে ভালকি আর ভ্যালাক্সিং বা ভ্যালাটের প্যাঁচ কষায় কী করে?

শিয়ালনি ওদের পড়াচ্ছিল ‘জানোয়ার ইতিহাস’। বাঘু একটু দূরে আপনমনে একা একাই কিতকিত খেলে যাচ্ছে। সেদিন বাঘিন্নী এসে ওইসব বলে যাওয়ার পর থেকে শিয়ালনিও আর বাঘুকে তেমন কিছু বলে না।     

শিয়ালনি পড়াচ্ছিল, “জন্তুদের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যুগে যুগে বহু মহান জানোয়ার আবির্ভূত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে যাঁর নাম সবার প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় তিনি মহান শিম্পাঞ্জি শিম্পাঞ্জিয়ানা তানানা। পরম বুদ্ধিমতী শিম্পাঞ্জিয়ানা তানানার আমলেই প্রচুর পরিমাণে বৃক্ষরোপণ, জন্তুজানোয়ারদের বসবাসের জন্য প্রভূত সংখ্যায় গুহা নির্মাণ ও গুহা সংস্কার ইত্যাদি নানাবিধ প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়। জন্তজানোয়ারদের মধ্যে বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রেও তিনিই পথিকৃৎ। তাঁর সর্বাপেক্ষা প্রবল ও শক্তিশালী প্রতিপক্ষ ছিল এক পালোয়ান বাঘ, যার নাম বাঁঘাক হাঁকডাক! কিন্তু শিম্পাঞ্জিয়ানা তানানা তাকেও…”

          এই পর্যন্ত পড়িয়েছে শিয়ালনি, হাতুশি তার শুঁড়টাকে খুব চিন্তার ভঙ্গিতে ঝুলিয়ে বলল, “কিন্তু দিদিমণি, বাঘুর কী হবে? বাঘুর এই অবস্থা যে আর চোখে দেখা যাচ্ছে না!”

          কুমরু থাবা নাড়িয়ে সায় দিল, “হ্যাঁ দিদিমণি, এই যে আমরা সবাই এত কষ্ট করে লেখাপড়া করছি, আর ও মনের আনন্দে কিতকিত খেলে যাচ্ছে, এটা তো ঠিক দেখায় না দিদিমণি।”

          ভালকি বলল, “হ্যাঁ দিদিমণি, তাড়াতাড়ি বাঘুকে সারানোর ব্যবস্থা করুন।”

          বাঘুকে কিভাবে সারিয়ে তোলা যায়, তাই নিয়ে বিস্তর আলাপ- আলোচনা চলল। ডাক্তার বদ্যি তো দেখাতেই হবে। খরগোশাই ডাক্তারদিদির দাওয়াইখানাতে খোঁজ করে জানা গেল উনি বিলেত গেছেন। সেখানকার অ্যানিমালার্ড ইউনিভার্সিটি আর অ্যানিমালব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে ঘাসোপ্যাথি নিয়ে ভাষণ দেবেন।  

          হিনিমিনি বলল, “দিদিমণি, আমার দিদাকে দেখাবেন একবার? আমার দিদা তো জানেনই, বিখ্যাত কদলীপ্যাথি চিকিৎসক। বহু রোগীর বহু বিচ্ছিরি রোগ সারিয়েছেন উনি। একবার তো এক বিদেশি লেমুর এসেছিল ওঁর কাছে। লেমুরদের লেজ ভারি সুন্দর চাকা চাকা দেখতে আর লম্বা হয়! তা সেই লেমুরের লেজ কোন কারণে শুকিয়ে শুকিয়ে ইঁদুরের লেজের মতন সরু আর এইটুকুনি হয়ে গিয়েছিল! লেমুরকুলে তাঁর তো মান ইজ্জত সব গেল! ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে, তাঁর নাম ছিল লেমুরটুস ভুসভুস। তা সেই লেমুরটুস ভুসভু্সের রোগ কোন বিদেশি ডাক্তারই সারাতে পারল না। তারপর তিনি কোনওভাবে আমার দিদার খোঁজ পেয়ে ভারতে চলে আসেন।    

           “দিদা যথারীতি তাঁর রোগ সারিয়েও দেয়। ওঁর লেজের চিকিৎসার জন্যই দিদা আবার আলাদা একটা যন্ত্র উদ্ভাবন করে, যার নাম দেয় টেলথোস্কোপ। মানুষদের যেরকম স্টেথোস্কোপ থাকে না, সেরকম। তবে এটাতে নাকি খালি লেজের ব্যাপারস্যাপারই দেখা হয়।

          “তা সে যাই হোক, টেলথোস্কোপ আর দিদার বানানো নানারকম বড়ি আর রসের কল্যাণে একমাসেই তাঁর লেজের অভাবনীয় উন্নতি দেখা গেল। পুরনো লেজখানা খসে গিয়ে নতুন লেজ গজালো, সে লেজ হলও দেখার মত। লেজ শুধু বাড়লই না, আগে যা দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ছিল, তার চেয়েও বেড়ে গেল। লেমুরটুস ভুসভুস তো মহা খুশি।

          “ম্যাডাগাস্কারে ফিরে যাবার সময় লেমুরটুস ভুসভুস একটা চন্দনকাঠের ইয়া ব্বড়ো বাক্সে অনেক বাওবাব গাছের বীজ আর সেই খসে যাওয়া ইঁদুরমার্কা লেজ উপহার দিয়ে গেল দিদাকে। আর বলে গেল, ডিয়ার হ্যানুমাটিস্যোরি, এই স্যাণ্ডালউডের বক্সে হামার টেল ডেকিলে টুমি হামার কতা সোরোন করিবে!”

          কুমরু অবাক হয়ে গালে থাবা ঠেকাল, “তার মানে?”

          হিনিমিনি বেজায় বিজ্ঞ বিজ্ঞ একখানা হাসি দিল, “আরে, এইটাও বুঝলি না? মানে হল, ডিয়ার হনুমতীশ্বরী, এই চন্দনকাঠের বাক্সে আমার লেজ দেখলে তুমি আমার কথা স্মরণ করবে!”

          শুনেই সবাই হো হো করে হেসেই কুটোপাটি। বাঘুও হাসি শুনে ছুটে এসেছে, “এত হাসি কিসের? এখানে কি লাফিং ক্লাব খোলা হয়েছে?”

          শিয়ালনি বলল, “এই গল্পের আওয়াজ শুনেই বাঘু যখন দৌড়ে এসেছে, তার মানে তোর দিদার কাছেই কাজ হবে রে, হিনিমিনি! বাঘিন্নীকে আমি আজই গিয়ে বোঝাই।”

          পরের সপ্তাহে কদলীস্তানে গিয়ে ওদের চোখ ছানাবড়া। পাঠশালা দিন সাতেকের জন্য ছুটি দিয়ে দিয়েছে শিয়ালনি, আর তারপর বাঘু সহ সবাইকে নিয়ে চলে এসেছে হিনিমিনির দিদার ডেরায়, যার নাম কদলীস্তান।

          কদলীস্তানে গিয়ে সত্যিই ওদের চোখ মোটা মোটা মর্তমান কলার মতো হয়ে গেল! যেদিকে তাকাও সারি সারি কলাগাছ! কত রকমের যে কত কলাগাছ- কাঁঠালি কলা, সিংগাপুরি কলা, চাঁপাকলা, চাঁপাকলা, সবরি কলা, মর্তমান কলা, আরও কত কী!

          গাছে গাছে নানা ধরনের পোস্টার ঝুলছে- ‘শাখামৃগদের বাসস্থানে আপনাদের স্বাগতম্‌! আসুন, কলা খান, কলা খেয়ে সুস্থ থাকুন!’, কিংবা ‘ভালো থাকতে খাও কলা, দূর হবে সকল জ্বালা!’, কিংবা ‘শুন শুন শুন সর্বজন। কলার অপূর্ব ব্যাখ্যান করি হে বর্ণন।। একলম্ফে সাগরপাড়ি দিতে কেহ নারিল। রম্ভাতেজে বলীয়ান হনু সাগর উতরিল।।’

          হিনিমিনির দিদা, অর্থাৎ বিখ্যাত কদলীপ্যাথি চিকিৎসক হনুমতীশ্বরী ধন্বন্তরির বাসার নাম ‘রম্ভা মঞ্জিল’। তাঁর একজন সবসময়ের কাজের হনুমান থাকে, তার নাম হনুধুমসো। আর আছে কদলীপ্যাথি চিকিৎসার জন্য তাঁর দুই সহযোগী-  হনুখোঁচা আর হনুচরকি। তারা আবার দুই যমজ ভাইবোন। এছাড়াও দিনের বেলায় ওষুধ বানানোর জন্য বেশ কিছু হনুমান আসে।  

          হিনিমিনি ফিসফিস করে বলল, “বুঝলি, হনুখোঁচাদাদা প্রায়ই কাজে গণ্ডগোল করে আর খুব ঢিলেঢালা। আর হনুচরকিদিদি ঝটাপট ঝটাপট কাজ করতে যায়, আর নানা ঝামেলা বাধায়। এদের দুজনকে সামলাতেই দিদা জেরবার!”

          দেখা গেল তাই-ই। ওরা পৌঁছোতে না পৌঁছোতেই হনুচরকি কোত্থেকে ছুটে এসে ভালকির হাত ধরে নিয়ে গিয়ে একটা বিছানায় শুইয়ে দিল। তারপরই সরু সূচ লাগানো একটা নল বের করল। হাতুশি উঁকি মেরে দেখল, নলের গায়ে লেখা- কদলী রস সূচিকা।

           ভালকি সমানে বলার চেষ্টা করছে- “আমাকে কেন, দিদি? আমার তো কিছু হয়নি। আমি তো ঠিক আছি।”

          হনুচরকি চোখ পাকিয়ে বলল, “চোওওপ! একটা কথা না। আমি হনুমতীশ্বরী ধন্বন্তরির কাছে সব শুনেছি। তুমি সব ভুলে যাচ্ছো। কই রে হনুখোঁচা, কদলী রসটা আনতে এত সময় লাগে? তাড়াতাড়ি দে, আমি রসটা ভরে ওর হাতে সূচিকা প্রবেশ করাই!”

          কপাল ভালো, হনুখোঁচা সব কাজেই বিস্তর দেরি করে। হনুখোঁচার আসতে আসতে এতোই সময় লাগল যে তার ফাঁকে ভালকি কোনমতে হালকা একখানা ভালুক্সিং-র প্যাঁচ দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “আমি না। আমি না। ওই যে বাঘু। ওর শরীর খারাপ!”

          হিনিমিনি ফিসফিস করে বলল, “বুঝলি, এটাও মজা। হনুচরকি সবই চরম চটপট করতে যায়, আর হনুখোঁচা পরম ধীরে। ফলে দুটোতে মিলে ব্যালান্স হয়েই যায়! তাই দিদাও কোনরকমে নিজের কাজ চালাতে পারে!”

          শিয়ালনি ততক্ষণে পেছন পেছন বাঘুকে নিয়ে হাজির। শিয়ালনিকে দেখেই সাঁতারের ডাইভ দেবার মতন একখানা ধাঁই করে ডাইভ দিল হনুচরকি আর সোজা গিয়ে ল্যাণ্ড করল শিয়ালনির পায়ে। আর সেই ধাক্কা সামলাতে না পেরে শিয়ালনি ধাক্কা দিল বাঘুর গায়ে, বাঘু গিয়ে পড়ল কুমরুর ঘাড়ের উপর, আর কুমরু টাল সামলাতে না পেরে সজোরে ঠেলা দিয়েছে হাতুশিকে। আর সেই সময়েই হনুখোঁচা আসছিল বড় এক হাঁড়ি ভর্তি কদলী রস নিয়ে। তা হাতুশির চেহারাখানাও আর হেলাফেলার বস্তু নয়! হাতুশির ধাক্কায় কদলীরসের হাঁড়ি থেকে কলার রস ছিটকে একাকার! হাতুশি তারই মধ্যে শুঁড় বাড়িয়ে শূন্যপথ থেকে কিছুটা কলার রস শুঁড়ে শুষে নিয়ে চালান করল মুখের ভিতর।

হিনিমিনি এদিকে তুড়ুক তাঁই করে লাফ দিয়ে কখন উধাও হয়েছিল কেউ জানে না। এতক্ষণে দিদার লেজ ধরে পিছন পিছন এসে হাজির হল। তার পিছন পিছন বিশাল একটা ট্রে নিয়ে হনুধুমসো। ট্রে-তে ওদের সবার জন্য কলার রসের শরবত, রকমারি কলার মিষ্টি, কলার শিঙাড়া এইসব।

          রম্ভা মঞ্জিল জায়গাটা ভারি সুন্দর। অবশ্য পুরো কদলীস্তান-ই তাই। যতদুর চোখ যায়, রকমারি কলাগাছের খেত যেমন আছে, তেমনই অন্যান্য নানা গাছও বিস্তর। রম্ভা মঞ্জিলটা দুটো বড় কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়া গাছের মধ্যিখানে। এদিকের ওদিকের নানা গাছের উপর সুন্দর সুন্দর থাকার ঘর করা আছে। সেসব ঘরে রাত্রে থাকার ব্যবস্থা। নিচে খোলা জায়গার একপাশে একটা বড়ো মাটির উনুনে বিশাল কড়াইতে টগবগ টগবগ করে কলার রস ফুটছে। একপাশে এক হনুমান বিশাল এক হামানদিস্তায় শুকোনো কলার গুঁড়ো বানাচ্ছে। সেসব দিয়ে হিনিমিনির দিদা পরে ওষুধ বানাবেন। একটা বকুল গাছের তলায় দুজন হনুমান কলার ছোট ছোট টুকরো কেটে একটা থালায় জড়ো করছে। সেসব আবার তদারকি করছে হনুপল্টন নামের এক হনুমান।

          দু-দিন বাঘুকে এটাসেটা পরীক্ষা করার পরই হিনিমিনির দিদা বাঘুকে একটা আলাদা ঘরে রেখে কিসব পরীক্ষা নিরীক্ষা করছেন। তার নাকি ভয়ানক ব্যামো। ওদের বলে দিয়েছেন, নিজেদের মতো করে ঘুরতে ফিরতে। বাঘুর কাছে না ঘেঁষতে। এ অসুখ নাকি এমনই যে লোকজন বেশি কাছে থাকলে বেড়ে যায়!

          তা কদলীস্তানের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াতে দিব্যি লাগছে ওদের। চমৎকার জায়গা। যেমন খুশি ঘোরো এধার ওধার, আর রাস্তার এদিকে সেদিকে হরেক কিসিমের হনুমান নানারকম পসরা সাজিয়ে বসে আছে। অনেক ফেরিওয়ালা হনুমান আবার ‘রম্ভা লজেন্স’, ‘কদলী বিস্কুট’, ‘কলা চুরমুড়’ ইত্যাদি হাঁক মেরে ফিরি করে বেড়াচ্ছে। হনুমতীশ্বরী ধন্বন্তরির অতিথি বলে ওদের থেকে কেউ এক পয়সাও নিচ্ছে না। বরং যেচে খাওয়াচ্ছে!

          হাতুশি তো দেদার কলার পুর দেওয়া ফুচকা খেয়েই যাচ্ছে! আলুসেদ্ধর বদলে কাঁচকলাসেদ্ধর পুর- টকাটক শুঁড়ে পুরছে হাতুশি আর মুখের ভেতর চালান দিচ্ছে। কাঁচকলার পুর দেওয়া চপ যার নাম ‘চপখাই’ খেয়ে ভালকি পুরো আকাশে ভাসছে এমন হাল! উৎসাহের চোটে পুরো দোকানই সাবাড় করে দেয় আর কী! কুমরুর আবার পছন্দ কলার বরফি ‘কদলীফি’, কলার রসগোল্লা ‘কলাগোল্লা’ এইসব।

          শিয়ালনি দিদিমণি আবার এসবে নেই। তিনি কলা-যোগ (ইয়ে মানে, জলযোগের মতনই ব্যাপার আর কী!) সারছেন রম্ভাবল্লভী (রাধাবল্লভী মার্কা ব্যাপারস্যাপার!), কিলিপি (কলার জিলিপি) আর কুলনি (কলার ঘুগনি) দিয়ে আর মাঝেমাঝেই মন্তব্য করছেন, “এ যে দেখি রীতিমতো কলাসুলভ বন্দোবস্ত! তোর দিদার এখানে না এলে এমন সব চমৎকার ব্যাপারস্যাপার অজানাই থেকে যেত রে হিনিমিনি!”

          ওদিকে হিনিমিনির কিন্তু খাবারদাবারের ব্যাপারে মোটে আগ্রহ নেই। সে মাঝেমাঝেই আসে এখানে ছুটিছাটায়, এসব খাওয়াদাওয়া তার অনেকটাই পেট-সওয়া! সে খালি এদিক ওদিক তুড়ুক তাঁই করে লাফাচ্ছে, আর চেনা পরিচিত যাকেই পাচ্ছে তার কোলে কাঁখে পিঠে চেপে, নইলে লেজ ধরে ঝুলে গল্প জুড়ছে!

          পাঠশালার বাকিরা যখন মহানন্দে আছে, বাঘুর তখন ভয়ানক দুর্দশা! একখানা খাটে তাকে সারাদিন শুইয়ে রেখেছে হিনিমিনির দিদা। নড়া চড়া, খাট থেকে ওঠা, বেশি কথা বলা- সবই বন্ধ। পাহারার জন্য কোন না কোন হনুমান সবসময় মজুত। সামান্যতম নড়নচড়ন দেখলেও হাঁইহাঁই করে ছুটে আসছে কেউ না কেউ- তোমার নড়াচড়া একদম বারণ কিন্তু। হনুমতীশ্বরী ধন্বন্তরি জানলে আমাদের একদিনের বেতন বাবদ প্রাপ্য কলার কাঁদি কেটে নেবেন!

          বেচারি বাঘু মনের দুঃখে একদিন গান জুড়তে গিয়েছিল বেশ দরদ দিয়ে-

                   কলার দেশে এসে আমি

                             কলা দেখি রে!

                   মনের ভুলের জেরে আমি

                                 নাকাল বেজায় রে!

          এইটুকুনিই মোটে গাইতে পেরেছিল বাঘু, একটা বেজায় গোদা হনুমান এসে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে তেড়ে এসেছিল, “অ্যাইয়ো বাঘু! মোটে চেঁচাবে না বুঝেছ? তোমার ওসব গান গাওয়া নিষেধ আছে। আমার নাম কপিদুরমুশ, বুঝেছ? আমার একদিনের বেতনের কলার কাঁদি কাটা গেলে তোমাকেই আমি দুরমুশ করে ছেড়ে দেব, বুঝেছ?”

          ভয়ে বাঘু চুপ করে গিয়েছিল তখনকার মত। কিন্তু আজ সাত দিন হয়ে গেল, বাইরে ওর পাঠশালার বন্ধুরা হুল্লোড় করে বেড়াচ্ছে, আর তার কপালেই এই!

          পাহারাদার দারোয়ানটার একটু ঢুলুনি মত এসেছে দেখে বাঘু চুপি চুপি পা টিপে টিপে উঠতে যাচ্ছিল, এমন সময়েই হিনিমিনির দিদা এসে উপস্থিত। বাঘুকে দেখেই মুচকি হাসি হাসলেন, “কী রে, বাঘু? বিছানা ছেড়ে উঠে গেছিস যে! তোর ভয়ংকর ফাঁকিবাজাইটিস রোগ হয়েছে, তা জানিস?”

          বাঘু ঘাড় চুলকোল, “দিদা, আমাকে ছেড়ে দিন এবারে। আমি ভালো হয়ে গেছি।”

          দিদা ঘাড় নাড়লেন, “উঁহু! বললেই হবে? টেলথোস্কোপে তোর লেজের অবস্থা খুব সুবিধের নয় দেখছি। তোর গায়ে এখন ফাঁকিবাজি দূরীকরণ সূচিকা ফুঁড়ব!”

          বাঘু হাঁউমাঁউ করে উঠল, “দিদা! দিদা! আমার আসলে… আমি আসলে…”

          দিদা গলা তুলে ডাকলেন, “শিয়ালনি, ভেতরে এসো।”

          শিয়ালনি দিদিমণি বাইরেই অপেক্ষা করছিলেন আজ। হিনিমিনির দিদা সেভাবেই বলে রেখেছিলেন কিনা। দিদিমণি ঢুকতেই হনুমতীশ্বরী ধন্বন্তরি গলা তুললেন, “বল্‌ এবারে বাঘু। আসলে… আসলে কী?”

          বাঘু একবার নাক চুলকোল, একবার কান চুলকোল, তারপরে একবার লেজও চুলকোল। তারপর বলল, “ইয়ে… মানে আমার কিছু হয়নি দিদা। আমাকে ছেড়ে দিন। এইভাবে আটকে থাকতে আমি আর পারছি না!”

          শিয়ালনির চোখ পুরো আলুর চপের মতোই গোল-গোল লাল- লাল, “বাঘু! বাঘুউউউউ! এতদিনে তার মানে তুই আমাদের বাঁদর নাচ নাচালি!”

          হিনিমিনির দিদা কিন্তু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা কুল কুল, “আহহা! ওরকম করছো কেন, শিয়ালনি? ওকে তো বলতে দাও সবটা। নে বাবা বাঘু, তুই বল।”

          বাঘু খুঁৎ খুঁৎ করে ফোঁপাতে শুরু করল, “ইয়ে… মানে দিদা… আমাদের দিদিমণির ওরম মুগুরমার্কা অঙ্ক বই… অঙ্ক করছি না মুগুর ভাঁজছি বোঝা দায়… সেসব নিয়ে ভালো কথা বলতে গেছিলুম… শোনেননি… উঁ হুঁ হুঁ হুঁ… তাপ্পরে… তাপ্পরে… উঁহুঁ হুঁ হুঁ… আমি যাত্রা দেখলুম… একটা লোক সব ভুলে যাচ্ছিল… তাই ইয়ে… মানে ভাবলুম… মানে ভাবলুম কী… উঁ হুঁ হুঁ হুঁ… আমিও যদি ওরম ভুলে যাই… তাহলে ভালোই হয়… তাই ভেবে… মানে মজার কথাই ভেবে… উঁ হুঁ হুঁ হুঁ… তা মজা তো ওনারাই সব নিয়ে নিলেন… আমি এখানে একলা পড়ে নাকাল হচ্ছি… উঁ হুঁ হুঁ হুঁ… আমাকে ছেড়ে দিন… ঊঁ হুঁ হুঁ হুঁ…”

          শিয়ালনি এবার তারস্বরে আছড়ে পড়ল, “উনি ছাড়লেও আমি তো তোমাকে ছাড়বো না বাঘু! চালাকি পায়া হ্যায়? কায়দাবাজি পায়া হ্যায়? এতদিন ধরে পাঠশালা বন্ধ করে তোর এই নাটকবাজি দেখার জন্য এখানে আছি? মাঝখান থেকে সবাই আমাকে যা নয় তাই বলে গেছে! হনুমতীশ্বরী ধন্বন্তরি মাসি, আপনি সত্যিই ধন্বন্তরি! এবারে বাঘুকে আপনি আরও দিন সাতেক আপনার এখানেই আটকে রাখুন, ও আপনার এখানেই পড়াশুনো করুক। কপিদুরমুশকে নাহয় ওর পাহারায় রেখে দিন! তাহলেই বাছাধন জব্দ হবেন! আমরা ফেরত যাই!”

          আর বাঘু? সে এবারে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে কান্নাই জুড়ে দিল, “হায় হায় হায় হায়! এ আমার কী হল রে এ এ এ এ … আঁই আঁই আঁই আঁই(কান্না)… কপিদুরমুশদাদা যে আমাকে এবারে দুরমুশ করে ছেড়ে দেবে রে এ এ এ এ … আঁই আঁই আঁই আঁই(কান্না)… আমি এবার কী করি রে এ এ এ এ … আঁই আঁই আঁই আঁই(কান্না)… আমারই যাত্রা বেরিয়ে গেল রে এ এ এ এ … আঁই আঁই আঁই আঁই(কান্না)…এবারে আমাকে সবাই বাঘিপিসী-মার্কা গরম দেখাবে রে এ এ এ এ … আঁই আঁই আঁই আঁই(কান্না)… আঁই আঁই আঁই আঁই(কান্না)…”।

……০……

 

 

বাঘু সিরিজের অন্যান্য গল্পগুলি থাবাছানি দিচ্ছে নিচের লিঙ্কেঃ-

১। বাগে এলো বাঘু

২। গিঁটের গেরোয় বাঘু

৩। বাঘু খেল ঘাস

৪। বাঘু হলেন মনিটর

৫। শিয়ালনী কুপোকাত

৬। অযোধ্যা পাহাড়ে বাঘু 

৭। পরীক্ষা দিলেন বাঘু

৮। গণ্ডারনী ও গণ্ডগোলিক্স

৯। নামতা শেখেন বাঘুবাবু

১০। শিয়ালনীর পাঠশালায় সিংহালু

১১। বাঘু হল চিৎপটাং 

১২। ঘুম দিলেন বাঘুবাবু  

১৩। পাঠশালায় ধুন্ধুমার

১৪। বাঘুবাবু ও জান্তা জট 

১৫। বনভোজনে বাঘুবাবু

১৬। হোলি খেলল হিনিমিনি      

১৭। ভোটে দাঁড়ালেন বাঘুবাবু

১৮। পাঠশালা মহাসভায় হাতুশি 

১৯। বাঘুর ল্যাজলজ্জা

২০। ছবি আঁকেন বাঘুবাবু         

২১। জানোয়ার বার্তা ও বাঘুবাবু

২২। উল্কার কবলে বাঘু

২৩। কবি সম্মেলনে বাঘুবাবু

২৪। বিদেশি মোলাকাতে বাঘু

২৫। বাঘু দিল গো- ও- ও- ল                                

Leave a comment

Check Also

উল্কার কবলে বাঘু

উল্কার কবলে বাঘু – মৌসুমী পাত্র

(শিয়ালনীর পাঠশালায় প্রচুর মজাদার ব্যাপার স্যাপার চলে, যার প্রথম হদিশটা  তোমাদের দিযছিলাম ‘বাগে এলো বাঘু’ …

শিল্পী- সোমক সেনগুপ্ত/ জানোয়ার বার্তা ও বাঘুবাবু

জানোয়ার বার্তা ও বাঘুবাবু – মৌসুমী পাত্র

  পিঠে থলে ঝুলিয়ে বাঘু চলেছে পাঠশালার পানে। মনে বেশ খুশি খুশি ভাব। একটা গাছের …

ছবি আঁকেন বাঘুবাবু- মৌসুমী পাত্র

ছবি আঁকেন বাঘুবাবু – মৌসুমী পাত্র

(শিয়ালনীর পাঠশালায় প্রচুর মজাদার ব্যাপার স্যাপার চলে, যার প্রথম হদিশটা দিয়েছিলাম ‘বাগে এলো বাঘু’ গল্পে। …

বাঘুর ল্যাজলজ্জা/ শিল্পী- গুঞ্জা

বাঘুর ল্যাজলজ্জা – মৌসুমী পাত্র

              গতকালের আগুনঝরা গরমটা আজ অনেকখানি নরম। দুপুরবেলাতেই দমকা কালবৈশাখী এসেছিল আকাশ কালো …