Home / বাঘু সিরিজ / বাঘু দিল গো-ও- ও-ল – মৌসুমী পাত্র

বাঘু দিল গো-ও- ও-ল – মৌসুমী পাত্র

 

গোল করলেন বাঘুবাবু
শিল্পী- পুণ্যতোয়া ধর

শীতটা এবারে কেমন যেন ল্যাজ গুটিয়ে পালিয়েছে! অন্যান্য বছর কার্তিক মাস পেরোতে না পেরোতেই লেপ কম্বল দেদারসে গায়ে চাপিয়ে হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে শীত বাহাদুর এসে হাজির হন! আর এবারে? তিনি যে কোনখানে নাকে ঠেসে সরষের তেল দিয়ে চেপে ঘুমোচ্ছেন, বোঝাই দায়!
তা শীত বাছাধন ঘুমের ঘোরে নাক ডাকুন ছাই না ডাকুন, জঙ্গলের মধ্যে শিয়ালনির পাঠশালা কিন্তু চলছে পুরোদমে। আর পাঠশালার সময়ে শিয়ালনির ‘ফুড়ুৎ ফোঁ, ঘুড়ুৎ ঘোঁ’ করে নাক ডাকার শব্দও শুনতে পাওয়া যায় কান পাতলেই।
বাঘু আবার কাজকাল করে কি, দিদিমণির নাকডাকার আওয়াজ বেরোতে শুরু করলেই সে নাকডাকার সুরে সুর মিলিয়ে গান জোড়ে-

ফুড়ুৎ ফোঁ, ঘুড়ুৎ ঘোঁ
পড়াশুনাটি ভোঁ ভোঁ।
বুকের মধ্যে ফাঁকির তুলো
ফাটে ফটাস ফোঁ!

শীত খেলেন কাটাকুটি
গোল দেবে কে?
খেজুর গাছের হাঁড়ি ফাটলে
রসটি চোঁ চোঁ!
ওরে, রসটি চোঁ চোঁ!

রস খাবেন বাঘুবাবু-
লেজমলা খাবে কে?
কুমরু আছে কী করতে?
রুমালে হাঁচছে!
ওরে, রুমালে হাঁচছে!

কুমরু সত্যি সত্যিই হাঁচছিল। তবে রুমালে নয়, গামছায়। শীত পড়লেই প্রতি বছর কুমরুর বেজায় সর্দি লাগে, আর সমানে হাঁচতে থাকে। ইয়াব্বড়ো একটা লাল গামছা গলায় বেঁধে আজকাল পাঠশালায় আসছে সে। হাঁচি পেলেই গামছার একটা খুঁট বাগিয়ে ধরে ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে হেঁচে নিচ্ছে। হাঁচতে হাঁচতেই কুমরু তেড়ে গেল বাঘুর দিকে, “অ্যাইয়ো বাঘু, আমি হাঁচছি বলেই… ফ্যাঁচ… তুই যা খুশি তাই গান গাইবি…ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ… তুই জানিস, শীতকাল এলেই আমি গায়ে কক্ষণো রেনকোট পরি না… ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ… আর সকালে রোজ চান করে পাঠশালে আসি… ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ… আর তাইতেই শীতকাল এলেই আমার বড্ডো হাঁচি পায়… ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ…।”


বাঘু আর কুমরুর ঝগড়া জোর জমে গেছে। ভালকি এদিকে তার থলে থেকে একটা ছোট টুথপেস্টের শিশি বের করে তারিয়ে তারিয়ে চাখছে। হাতুশি তার নিজের পড়া শেষ করে কিতকিত খেলছিল হিনিমিনির সঙ্গে। বাঘু আর কুমরুর চেঁচামেচিতে তাদের খেলার বিস্তর ব্যাঘাত হচ্ছিল।


হাতুশি তাই উঠে কোমরে দুই থাবা দিয়ে শুঁড় উঁচিয়ে প্রথমে বাঘু আর কুমরুকে দাবড়ানি দিল, “বাঘু! কুমরু! এসব কী হচ্ছে? এটা পাঠশালা না? এটা যখন খুশি গান গাওয়ার জায়গা? আর কুমরু, তুই সকালে সরষের তেল মেখে চান করতে পারিস না? আর তোদের কুমীরকুলে নিয়ম আছে না, চান সেরে গায়ে ভিটামিন ডি লাগানোর? মানে ইয়ে, রোদ লাগানোর? তুই কুমীর হয়ে এসব নিয়ম পালবি না, আমি হাতি হয়ে বলে দেব? এটা পাঠশালা না হাঁচার জায়গা?”


বলেই হাতুশি ফিরেছে ভালকির দিকে, “অ্যাইয়ো ভালকি, তুই দাঁতে টুথপেস্ট লাগিয়ে অমন হ্যা হ্যা করে হাসছিস যে বড়ো? এটা পাঠশালা না টুথপেস্ট খাবার জায়গা?”

বাঘু তেড়ে গেল হাতুশির দিকে, “আমার এখন গান পেয়েছে, আমি গান করবো!”
কুমরু হাঁচতে হাঁচতেই কোনমতে বলল, “আমার হাঁচি পাচ্ছে… ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ… হাঁচবো না আমি? ফ্যাঁচ ফ্যাঁচফ্যাঁচ ফ্যাঁচ…।”
ভালকি আঙুলে খানিকটা টুথপেস্ট মাখাতে মাখাতেই বলল, “আমি কি টুথপেস্ট খাবো না? খাবো না টুথপেস্ট আমি?”
হিনিমিনিকে কেউ কিছু বলেনি, তবুও সে বলল, “আর কিতকিত? কিতকিত খেলাও বারণ বুঝি?”


বাধ্য হয়েই হাতুশি চলল দিদিমণির কাছে। হাজার হোক, সে মনিটর। তার একটা দায়িত্ব বলে ব্যাপার আছে!


দিদিমণির ঝোপের কাছে গিয়ে দু-বার ‘দিদিমণি’, ‘দিদিমণি’ ডেকেও সাড়া পেল না হাতুশি। উপরন্তু ভেতর থেকে ধমাস ধমাস আওয়াজ ভেসে আসছে আর তার সঙ্গে দিদিমণির গলায় ‘ইয়াহু’, ‘এহেহে’, ‘আরে না’, ‘আরেব্বাস’ গোছের শব্দ শাঁইশাঁই করে কানে এসে ঢুকছে। শুঁড়খানাকে ঘাড়ের পিছন দিকে ঠেলে উঁকি মারল হাতুশি আর যা দেখল, তাতে তার শুঁড় আপনা আপনি সামনের দিকে সরে এসে কপালে উঠে গেল আর লেজখানা তার পেণ্ডুলামের মতন দুলতে থাকল তো দুলতেই থাকল!
ঝোপের মধ্যেই কিছুটা জায়গা ফাঁকা করে কোত্থেকে একটা মাছধরার জালের টুকরো দুটো খুঁটিতে আটকেছে শিয়ালনি। একটা বড়ো সাইজের বলকে জালের ঠিক মুখোমুখি বসিয়েছে। তারপর জালের দিকে পিছন ফিরে বলে শট নিল বিচিত্র কায়দায়। একটা আওয়াজ উঠল- দমাস! আর তার সঙ্গেই বলটা শিয়ালনির মাথার উপর দিয়ে উড়েগিয়ে জড়িয়ে গেল পিছনের জালে। জালের দিকে ফিরেই উল্লাসে ফেটে পড়ল শিয়ালনি, “গো-ও-ও-ল”।


হাতুশিও সব ভুলে থাবাতালি দিয়ে উঠল, “গো-ও-ও-ল! হুররে!”


শিয়ালনি খেলায় এতোই মগ্ন হয়ে ছিল যে হাতুশিকে খেয়ালই করেনিএতক্ষণ। হাতুশির গলার শব্দে পাশ ফিরে হাতুশিকে দেখেই ঘাবড়ে টাবড়ে গিয়ে হাত-পা ছুঁড়ে একাকার! “ই-ইয়ে কী বলে হা-হা-হা-হা-”
হাতুশি বুঝল দিদিমণি গোলের গেরোয় তার নামই ভুলে মেরে দিয়েছেন! তাই বলল, “হাতুশি!”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, হাতুশি। তা তুই ইয়ে মানে… তোর ক্লাসের গোলগুলো সব করেছিস তো? বাকিরাও সব গোল দিয়েছে তো?”
হাতুশি দেখে, গোলের তালেগোলে দিদিমণি সব গণ্ডগোল করে ফেলেছেন। তাই বলল, “দিদিমণি, ক্লাসে তো আমরা গোল করি না। বরং পড়া করতে আসি। তবে কিনা, বাঘুরা সত্যিই খুব গোল করছে!”
“অ্যাঁ? বলিস কী?”, লাফিয়েই উঠল শিয়ালনি, “গোল দিচ্ছে না? বলিস কী! তার বদলে গোল করছে? মানে, গোলমাল? না না, এ কোন কাজের কথা নয়। গোল না দিয়ে ক্লাসে গোল করা! না না, এসব মোটেই আমি সমর্থন করি না। চল্ তো, দেখি!”
বলেই তড়বড় তড়বড় করে হাঁটা লাগাল শিয়ালনি। পেছন পেছন হেলতে দুলতে গেল হাতুশি।


ভালকির টুথপেস্ট খাওয়া ততক্ষণে প্রায় শেষ। দিদিমণিকে দেখেই টুথপেস্টের শিশিটা তাড়াতাড়ি করে লুকোতে গেল ভালকি। কিন্তু শিয়ালনি দেখে নিয়েছে ততক্ষণে যা দেখার। গোল গোল চোখ করে তাকাল শিয়ালনি, “টুথপেস্ট খাচ্ছিলি বুঝি, ভালকি? আচ্ছা, আচ্ছা। তা বেশ, তা বেশ। আমার অবশ্য এমনিতেও টুথপেস্টের উপর লোভ নেই! তুই দিলেও কি আর আমি খেতুম?”
বলেই শিয়ালনি ফিরেছে বাঘুর দিকে, “বাঘু! বাঘুউউউউ! তুই নাকি গোল না দিয়ে গোল করছিলি?”
বাঘু কী একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই তুড়ুক করে এক লাফ দিয়েছে হাতুশি, “তোরা জানিস, আমাদের দিদিমণি যা দুর্দান্ত গোল করেন না! আমি স্বচক্ষে দেখেছি।”
শুনেই ধাঁই ধাঁই করে বারদুয়েক লাফাল বাঘু, “বলিস কী রে, হাতুশি? দিদিমণি, আপনি গোলও দ্যান! এইবারে বুঝেছি!”
কুমরু পাশে দাঁড়িয়ে হেঁচেই যাচ্ছিল। হাঁচি থামিয়ে ভয়ে ভয়ে শুধোল, “কী বুঝেছিস রে, বাঘু?”
বাঘু বিজ্ঞের মতো মুখ করে বলল, “দিদিমণি এত গোল দিতে ভালোবাসেন বলেই পরীক্ষার খাতায় আমাকে শুধুই গোল দেন! শুধুই কলমে করে গোল গোল দাগ! যেন কুড়ি টাকা সাইজের রসগোল্লা!”
রসগোল্লার নামে হাতুশির একটু লোভই হল। শুঁড়খানাকে মুখের ভেতর ঢুকিয়ে চেটেচুটেবলল, “আহহা! রসগোল্লার কথা তোলার অত দরকার কিসের, বাঘু? বেশ তো গোল নিয়ে কথা চলছিল, চলুক না!”


হিনিমিনি কখন যেন লাফ দিয়ে উঠে গিয়েছিল পাশের সেগুন গাছে। এইসব কথাবার্তা শুনে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল হাতুশির পিঠে। আর পিঠের ওপর বাগিয়ে বসেই আবদার জুড়ল, “না দিদিমণি, কথা না। শুধু কথায় কি আর কাঁচকলা থেকে পাকাকলা হয়? আমরাও গোল দেবো দিদিমণি। আপনি ব্যবস্থা করুউউউউন!”
ভালকি সায় দিল, “হ্যাঁ দিদিমণি, ঠাণ্ডাও পড়বে এবার! দু-চার পিস গোল না দিলে শরীরটা কেমন যেন দুব্বল- দুব্বল লাগছে!”
বাঘু তৎক্ষণাৎ পোঁ জুড়ল, “হ্যাঁ দিদিমণি, আমাদেরও গোল খেলার ব্যবস্থা করুন। পাঠশালায় পড়ছি, শীতকালে যদি খানকয়েক ধাঁই ধাঁই গোলই না দিতে পারলাম, তাহলে তো জীবন যেন … জীবন যেন…”
পাশ থেকে হাতুশি খেই ধরিয়ে দিল, “যেন নলেন গুড় ছাড়া শীতকাল!”
কুমরু একবার ফ্যাঁচ করে হেঁচে ঘাড় নাড়ল, “যেন মেঘলা দিনে শীতের রোদ পোয়ানো!”
হিনিমিনি বলল, “যেন খেজুর রস ছাড়া শীতের সকাল!”
বাঘু দেখল, বাকিরা সবাই তার কথার লেজুড় নিয়েই লোফালুফি করছে। তাই সেও বলল, “যেন লেপ ছাড়া শীতের রাত!”
মহা তিতিবিরক্ত হয়ে দাঁতমুখ খিঁচোল শিয়ালনি, “থামবি তোরা? খেলার কত নিয়মকানুন আছে জানিস? মানুষেরা এই খেলা নিয়ে কত কাণ্ডকারখানা করে, ধারণা আছে তোদের?”
ভালকি প্রশ্ন করল, “দিদিমণি, মানুষদের বল খেলার নাম কি?”
শিয়ালনী গম্ভীরমুখে জবাব দিল, “মানুষদের খেলার নাম ফুটবল। পা দিয়ে খেলে কিনা। তবে আমরা তো মানুষদের দেওয়া নাম নিই না কিনা। তাই আমরা বলি থাবাবল!”
হাতুশি বলল, “দিদিমণি, আমাদের এই থাবাবল খেলাটা শিখিয়ে দিন না!”
বাঘুর মুখ আহ্লাদী আহ্লাদী, “হ্যাঁ দিদিমণি, এখন আর বেশি ক্লাসফ্লাস করানোর দরকার নেই। বেকার আপনারও কষ্ট, আমাদেরও কষ্ট। তার চে’ বরং বেশি বেশি করে থাবাবলই খেলা যাক!”
কোমরে থাবা দিয়ে দাঁড়াল শিয়ালনি। চোখ দুটো যেন জ্বলন্ত আগুনের গোলা। আর কথা যখন বলল শিয়ালনি, রীতিমতো বোমা ফাটার আওয়াজ, “বাঘু! বাঘুউউউউ! খালি ফাঁকি মারার ধান্দা, না? তোর ফাঁকিবাজি আমি বের করছি! চল্, আর কোন কথা নয়, ‘বিজ্ঞানের বাঁধন’ বইটা খুলে বোস সবাই। এখন পড়া হবে। নো চালাকি, নো কায়দাবাজি!”


সবাই চুপ। খালি বাঘু দিদিমণির কান বাঁচিয়ে পাশে দাঁড়ানো ভালকিকে ফিসফিস করে বলল, “বিজ্ঞানের বাঁধন আর থাবাবলের হাউহাউ ক্রন্দন!”

বাঘু চটে ছিল বটে, কিন্তু তার গোঁসা ভাঙতে দেরিও হল না। ক্লাস শেষের পরই শুরু হয়ে গেল থাবাবল খেলা। ওদের পাঠশালার সামনের যে মাঠ, তারই একপাশে সেই মাছধরার জালটা লম্বা করে টেনে দুটো খুঁটির ওপর দিয়ে টাঙানো হয়েছে। শিয়ালনী খেলা বুঝিয়ে দিল সবাইকে- “শোন্, তোদের তো বললামই, আমরা জানোয়ারকুলের সব মহান জন্তুরা খেলি থাবাবল। মানুষদের মতো ওইসব ভুলভাল ফুটবল টুটবল আমরা খেলি না। আরে, ওরা তো খেলা শিখল আমাদেরই থেকে। অবশ্য এমনিতেও তো ওদের সারাদিনে কাজকম্মো কিছু নেই- খালি কাজই করে বেড়ায়! সবসময়েই দেখবি কাজই করে বেড়াচ্ছে। যেন পাগলা কুকুরে তাড়া করেছে। খেলে কখন? শোন্, এবার থেকে আমরা রোজ বিকেলে খেলবো। বুঝেছিস? খেলার বেলায় কিন্তু বিন্দুমাত্রও ফাঁকি নয়! নো চালাকি, নো কায়দাবাজি!”
কুমরু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “দিদিমণি, আপনিও খেলবেন?”
ঝাঁঝিয়ে উঠল শিয়ালনি, “খেলবো না তো কী রে হতভাগা? না খেললে তোরা খেলা শিখবি কী রে? যত্তসব!”
পরক্ষণেই কিঞ্চিৎ নরম হয়ে খেলার বাকি নিয়মকানুন ভালো করে বুঝিয়ে দিল শিয়ালনি। “শোন্, লেজে কিন্তু খবরদার কারুর যেন বল না লাগে। মানুষদের হাতে লাগলে বলে হ্যাণ্ডবল।কিন্তু মানুষের নিয়মকানুন আমরা নিই না কিনা। তাই আমাদের লেজবল। লেজ কিন্তু সবাই ভালো করে গুটিয়ে আসবি। নইলে লেজেলাগলে ‘আউল’ হয়ে যাবে!”
হাতুশি প্রশ্ন করল, “আউল কি, দিদিমণি?”
শিয়ালনি চটল না, বরং খুশি খুশি মুখে জবাব দিল, “এই যে তুই প্রশ্ন করলি, এতেই বোঝা গেল যে তোর আগ্রহ আছে। এই যে শেখার ইচ্ছে, এটাই আসল। বুঝলি? আউল কী, তাইতো? খেলার মাঝে কেউ কিছু খারাপ কাজ করলে তখন হয় ‘আউল’।মানুষদের যেমন ফাউল, আমাদের তেমনি আউল। মানুষদের দেওয়া নাম আমরা নিই না কিনা।”
আরও অনেক কিছু বোঝাল শিয়ালনি। থাবাবল খেলায় একটাই গোলপোস্ট, একজনই গোলকিপার। বাকিরা নিজেদের মতো খেলতে থাকে আর গোল করার চেষ্টা করতে থাকে। কেউ যদি গোল করে ফেলে তো ভালো, কিন্তু যদি গোলকিপার কারুর শট বাঁচিয়ে দেয়, তখন যার শট বাঁচিয়ে দেয়, সে তখন গোলকিপার হয়ে যায়। আর গোলকিপারও বাকিদের সঙ্গে ভিড়ে গিয়ে খেলতে থাকে। আর যে সবচেয়ে বেশি গোল করবে, সে হবে জ্যাম্পিয়ন! আর যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোল করবে, সে হবে জানার্স আপ! মানুষেরা আবার চ্যাম্পিয়ন, রানার্স আপ এইসব এইসব বলে!”
পশুপড়া করে (পাখিপড়ার মতো আর কী!) বোঝালো শিয়ালনি ওদের। সবশেষে বলল, “বুঝলি, ভেবে দেখেছি, মানুষদের চেয়ে আমাদের নিয়মটাই বেশি ভালো। কম জন হলেও খেলা যাবে, বেশি জন হলেও খেলার অসুবিধে নেই। গোলকিপার বেচারিরও গোল খেয়ে খেয়ে মন খারাপ হবার সুযোগ নেই! সেও বাকিদের মতন খেলতে টেলতে পায়!”


যাইহোক, থাবাবল খেলা শুরু হতেই বেধে গেল ধুন্ধুমার! বাঘু সামনের দুই থাবায় বল বগলদাবা করে ছুটতে থাকল তো ছুটতেই থাকল। শিয়ালনি বিস্তর হাঁকে, বেজায় চেঁচায়- কিন্তু বাঘুকে রোখে কার সাধ্যি? শেষমেশ ভালকি দৌড়ে গিয়ে ঘোরতর একখানা ভালুক্সিং-র প্যাঁচ ঝেড়ে চিৎপাত করে দিল বাঘুকে। (মানুষের যেমন বক্সিং, ওদের তেমনি ভালুক্সিং। মানুষের দেওয়া নাম ওরা নেয় না কিনা!)
গায়ের ধুলো ঝেড়ে উঠল বসে বাঘু, কিন্তু উঠেই চোটপাট শুরু করে দিল ভালকির ওপর। “তুই আমার ওপর আউল করলি যে বড়? নে, তুই এবার গোলকিপার হ।”
শিয়ালনি সহ বাকিরাও ছুটে এসেছে ততক্ষণে। শিয়ালনির গলার আওয়াজ তো নয়, যেন চকলেট বোমা! “বাঘু! বাঘুউউউউউ! ভেবেছিস কী? বলি, তুই ভেবেছিসটা কী? এইভাবে বল নিয়ে দৌড়োবি আর বাকিদের খেলা বরবাদ করবি! যা গিয়ে গোলে দাঁড়া! কুমরু, তুই চলে আয়! বাঘু এবারে গোলকিপার হবে।”
বাঘু তারস্বরে হাঁইমাঁই জুড়ল, “ও দিদিমণি, মিস গো! এভাবে আমার খেলাজীবনটা বরবাদ করবেন না গো! আমি গোল খাবো না গো-ও-ও-ও, গোল খেয়ে আমার পেট ফুলে ঢোল হয়ে যাবে গো-ও-ও-ও…”।
এক দাবড়ানিতে বাঘুকে থামিয়ে দিল শিয়ালনি, “বাঘুউউউ! আর একটাও বাড়তি কথা শুনতে চাইনা। তুই এক্ষুণি গিয়ে গোলে দাঁড়াবি, ব্যস!”
দিদিমণির ধমকানিতে বাঘু গিয়ে গোলে দাঁড়াল বটে, কিন্তু গজগজ করতে থাকলই সমানে, “এঁ হেঁ হেঁ! যত নিয়ম সব বাঘুর জন্য! আমিই ভালুক্সিং খাবো, আবার আমিই বকা খাবো! আবার সেই আমাকেই গোল খেতে হবে! অথচ অন্যের টিফিন কেড়ে খেতে যাও, তার বেলাতেও বাঘুর কপালে সেই ধমক খাওয়া!”
বাকি সময়টা বেচারি বাঘু এমনই মনমরা হয়ে রইল যে একটা গোলও বাঁচাতে পারল না। সমানে গোল খেল তো খেয়েই গেল!

পরের দিন ক্লাসে অঙ্ক করতে দিয়েছে শিয়ালনি। প্রথম অঙ্ক- একটি থাবাবল ম্যাচে মোট ২০টি গোল হয়েছে। তার মধ্যে ১/৪ অংশ গোল করেছে মেছোভূত, ২/৫ অংশ গোল করেছে গেছোভূত। যদি মোট তিনজনে মিলে খেলা হয়ে থাকে, তাহলে শাঁখচুন্নী কত গোল করেছে?
প্রথম অঙ্কটা পড়েই বাঘুর ভেতরের নাড়িভুঁড়ি কিরকম যেন ভুসভুসিয়ে উঠল। পাশে বসা কুমরুর দিকে তাকাল বাঘু। আজ আবার একটা হলুদরঙা ডোরাকাটা গামছা গলায় বেঁধে এসেছে কুমরু। সেই গামছাটাকে নাকে চেপে ধরে কলম বাগিয়ে তেড়ে অঙ্ক কষে যাচ্ছে কুমরু। তার নাকি আবার ভগ্নাংশের অঙ্ক কষতে ভারি ভালো লাগে!
পেনসিলের পেছনটা মুখে চুষতে চুষতেই কুমরুকে গুছিয়ে কিছু গালাগালি দেবে ভাবছিল বাঘু। ধুস ধুস, পেনসিলগুলো চুষতেও যে কেন এমন কাঠ কাঠ লাগে কে জানে! একটু চকলেটের প্রলেপ যে কেন দিয়ে রাখে না পেনসিলগুলোয়, কে জানে?তাহলে দিব্যি নানান ফন্দিফিকিরও ভাবা যেত আর চকলেটও খাওয়া যেত!
ভাবতে ভাবতেই বাঘুর চোখ গেল শিয়ালনির দিকে। দিদিমণি একদৃষ্টিতে তারই দিকে তাকিয়ে আছেন। বাধ্য হয়েই পেনসিলটা মুখ থেকে বের করে যাকে বলে, অভিনিবেশ সহকারে পর্যবেক্ষণ করল সে। তারপর নিজের মনেই জোরে জোরে ভারি চিন্তার সুরে মন্তব্য করল, “পেনসিলটা আমার মুখের ভিতর ঢুকল কী করে, কে জানে?”
শিয়ালনি এতক্ষণ দূর থেকে বাঘুর কার্যকলাপ সবই লক্ষ্য করছিল। এবারে লেজ কাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে এগিয়ে এল, “বাঘু, তোর এই এতাল বেতাল অনেকক্ষণ ধরেই দেখছি আমি। সমস্যাটা কী তোর? পেনসিল চুষতে আর ভালো লাগছে না? এবারে খাতা চুষবি?”
বাঘু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কোনমতে বলল, “ইয়ে ম্-মানে খাতাতেও তো চকলেট লেপা নেই, দিদিমণি। থাকলে চোষা যেত!”
“ও! খাতায় তোর জন্য এবার থেকে চকলেট লাগিয়ে রাখতে হবে? আর সেই চকলেট তুই চুষে চুষে খাবি! ভগ্নাংশের অঙ্ক এত করে কাল বোঝালাম তোদের, করতে কী হয়?”
ধাতানি খেয়ে বাঘু আরও কিরকম যেন এলোমেলো হয়ে গেল, “ইয়ে, মানে দিদিমণি, মানে ইয়ে, মানে আমি আ-আসলে ভাবছিলাম, কত ভগ্নাংশ পেনসিল চুষব আর কত ভগ্নাংশ খাতা?”
বলেই বাঘু ফ্যালফ্যাল নয়নে চাইল দিদিমণির দিকে। তা শিয়ালনি কি আর ওসবে ভোলে? দোদোমা ফাটানো রবে চিৎকার করল শিয়ালনি, “বাঘু! বাঘুউউউ! তুই এক্ষুণি বাইরে গিয়ে লম্বাগুড়ি দিবি, দিয়েই যাবি, বুঝেছিস? যতক্ষণ না আমি কিছু বলি!”
মুখ গোঁজ করে লম্বাগুড়ি দিতে চলে গেল বাঘু! দুপেয়েরা যখন চার হাতে পায়ে ভর দিয়ে হাঁটে, তাকে বলে হামাগুড়ি। আর জন্তুজানোয়ারেরা পিছনের দু-পায়ে ভর দিয়ে সামনের দু-পা তুলে হাঁটলে তাকে বলে লম্বাগুড়ি।
হাতুশির অঙ্ক হয়ে গিয়েছিল। খাতাটা দিদিমণির কাছে জমা দিয়ে বলল, “দিদিমণি, আমি বরং বাইরে গিয়ে দেখি বাঘু ঠিকঠাক লম্বাগুড়ি দিচ্ছে কিনা।”
শিয়ালনির মেজাজ এমনিতেই গরম হয়ে ছিল, হাতুশির কথায় আরও গেল বিগড়ে। “তোমাকে আর বাঘুর পাহারাদারি করতে হবে না, হাতুশি। এখানেই চুপচাপ বসে থাকো। তুইও এবারে বাঘুর মতো ফাঁকিবাজি শুরু করেছিস, না? কাল থাবাবলের কাণ্ডকারখানা তুই-ই শুরু করেছিলিস। এইসব করে কাল ক্লাস বিগড়োলি। আজ আবার ক্লাস পণ্ড করার মতলব, না?”
হাতুশি ভালো মেয়ে, ভালো মনেই বলেছিল কথাটা। কিন্তু দিদিমণির বকুনি খেয়ে তার মন খারাপ হয়ে গেল। মাথা নিচু করে বসে পড়ল সে। চোখ থেকে এক-দু ফোঁটা জল পড়ে মাটির ধুলোতে মিশেও গেল। কেউই খেয়াল করল না ব্যাপারটা। এমনকি, তার প্রাণের বন্ধু হিনিমিনি পর্যন্ত এতোই অঙ্ক করায় মগ্ন যে কিছু যে তার কানে গেছে, মনেই হল না।


পাঠশালার ভেতরে যখন এইসব চলছে, ওইদিকে তখন বাঘু প্রথম কয়েকবার বেশ মন দিয়ে লম্বাগুড়ি দিল। তারপর ইতিউতি তাকিয়ে দেখল, নাহ্! হাতুশিকে দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিন বাঘু লম্বাগুড়ি দিতে এলেই দিদিমণি পিছু পিছু হাতুশিকে পাঠান নজরদারি করতে। আজ মনে হয় হাতুশি অ্যায়সান গেছোভূত আর শাঁখচুন্নীর পাল্লায় পড়েছে যে আর পালাতে পথ পাচ্ছে না!
লম্বাগুড়ি থামিয়ে দিল বাঘু। মাঠের একধারে থাবাবল খেলার জালের পাশে বলটা আপনমনে পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে। বাঘুর মনে হল, বলটা শুয়ে শুয়ে বড্ডো অলস হয়ে যাচ্ছে। বলটাকে কিঞ্চিৎ দৌড়ঝাঁপ করানো উচিত। আর তাছাড়া, বাঘুকে গতকাল সবাই মিলে ষড়যন্ত্র করে একধারসে গোলের মালা পরিয়েছে। তারও একটা প্রতিবাদ কিংবা প্রতিশোধ নেওয়া একান্ত আবশ্যক।
এইসব সাতপাঁচ গুরুতর চিন্তাভাবনা করে বলটাকে হুড়ুদ্দুম এক লাথি কষাল বাঘু। বলটা আপনমনে শান্তিতে ঘুমোচ্ছিল, আচমকা এরকম একটা আক্রমণের জন্য মোটেই মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল না। সহসা লাথি খেয়ে কোনদিকে যাবে বুঝতে না পেরে পাঠশালা পানে যাওয়াই সাব্যস্ত করল। দিদিমণি তখন হিনিমিনির খাতা দেখছিলেন। অঙ্কের শেষেহিনিমিনি উত্তর লিখেছে- অতএব শাঁখচুন্নী গোল করেছে…
ধমাস ধাম! কোন্দিক থেকে একটা বল এসে ধড়াম করে পড়ল খাতার উপরে আর গেছোভূত, মেছোভূত আর শাঁখচুন্নী সব কেতরে ছেতরে একাকার! আর দিদিমণিও তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় উঠে দাঁড়িয়েই সপাটে একখানা লাথি কষালেন বলে আর সে বল পরপর এত ধাক্কা সামলাতে না পেরে লাফ দিয়ে আকাশপথে সোজা পাড়ি দিল মাঠের দিকে।

মন খারাপ বেবাক ভুলে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠল হাতুশি, “হুররে! গোল করেছেন দিদিমণি!”
হিনিমিনিও খাতা ছিঁড়ে যাবার দুঃখ ভুলে গলা তুলল, “গোলটি খেল শাঁখচুন্নি!”
কুমরু গামছায় নাক মুছতে মুছতেই উত্তর দিল, “ভূতেদের মানহানি!”
ভালকি দুখী দুখী মুখে ঘাড় নাড়ল, “ভগ্নাংশ নয়, গোটা গোলখানি!”
শিয়ালনি বেজায় রেগেমেগে হাত-পা ছুঁড়ল, “থামা তোদের বকবকানি!”
বলেই ফের বলল, “ক্লাসের মাঝে বল ছোঁড়া? দিনের বেলা রাহাজানি?”
বলেই ফের ভুরু কোঁচকাল, “কিন্তু বল এল কোথা থেকে? দেখতে হচ্ছে ব্যাপারখানি!”

বলেই চশমাটাকে ঠেলে মাথার উপরে তুলে চোখদুটোকে চারপাশে চরকিপাক খাওয়ালো শিয়ালনি। তারপরই দুমদাম পা ফেলে এগোতে থাকল সামনের দিকে।
বলটা পাঠশালার দিকে উড়ে যাবামাত্রই প্রমাদ গুনেছিল বাঘু। তার পরে আবডাল থেকে উঁকি মেরে এতক্ষণ সে সবকিছুই দেখেছে, শুনেছে। দিদিমণি পা ফেলে এগোতেই বাঘুও তাড়াতাড়ি করে ছুটে গিয়ে একমনে সোনা বাঘের মতন মুখ করে লম্বাগুড়ি দিতে শুরু করল। দুনিয়ার কোথায় কে গোল করল, কে গোল খেল- কিছুতেই যেন তার কিছু আসে যায় না!


শিয়ালনি আর তার পিছন পিছন বাকিরা এসে বাঘুকে দেখে তাজ্জব! বাঘু যে আদৌ তাদের বিন্দুমাত্রও খেয়াল করেছে, দেখে মনেই হচ্ছে না। শিয়ালনি পেল্লায় এক হাঁক দিল, “বাঘু! বাঘুউউউউ!”
বাঘু পাশ ফিরে দেখে কতই যেন না অবাক হয়েছে এমন ভান করে বলল, “অ্যাঁ, দিদিমণি, আপনি? ওরাও সবাই যে! কী হয়েছে দিদিমণি?”
শিয়ালনি জ্বলজ্বলে চোখে চাইল, “বাঘু! এখানে যে বলটা ছিল, গেল কোথায়?”
বাঘু নিতান্ত সরলমুখে বলল, “বল কোথায় আমি কী করে জানব, দিদিমণি? আপনি তো আমাকে বল খেলতে বলেননি, লম্বাগুড়ি দিতে বলেছেন। তাই-ই দিচ্ছি। হুঁ হুঁ বাবা লম্বাগুড়ি, দিলে পরে কমবে ভুঁড়ি। …কমবে ভুঁড়ি… কমবে ভুঁড়ি…।”
এই বলে গান গাইতে গাইতে বাঘু ফের লম্বাগুড়ি দেওয়া শুরু করতে গেল। শিয়ালনি চোখ সরু করে সেদিকে খানিক তাকাল।তারপর বাঘুর সামনে গিয়ে কোমরে থাবা দিয়ে দু-চোখে দু-খানা আগ্নেয়গিরি বসিয়ে তাকাল, “বাঘু, তুই কিছু দেখিসনি, জানিসনা- এই আমাকে বিশ্বাস করতে হবে?”
বাঘু মুখচোখ গোঁজ করল, “আমার দিকে অমন করে চাইবেন না দিদিমণি। আমার কেমন কেমন ভয় লাগছে। আমাকে বকলে কিন্তু আমি কেঁদেও দিতে পারি!”
“একদম চালাকি করবি না বাঘু। বলটা উড়ে গিয়ে জুড়ে বসল, বলতে চাস?”
“কোন্ বল, দিদিমণি? এমনিতেই লম্বাগুড়ি দিতে দিতে আমি গায়ে মোটে বল পাচ্ছি না।”, বাঘু মুখচোখ যথাসম্ভব করুণ করার চেষ্টা করল।
কিন্তু শিয়ালনি কি আর ওসবে ভোলে? “বাঘু, বলের ওপর তোর কাদামাখা থাবার ছাপ আমি স্পষ্ট দেখেছি!”
বাঘু মুখ ফসকে বলেই ফেলল, “থাবার ছাপ কী করে থাকবে দিদিমণি? আমি তো ভালো করে থাবা মুছে তবেই বলে থাবা দিয়েছি!”
বলেই জিভ কাটল বাঘু। ইসস! বড্ডো ভুল হয়ে গেল। তাইতো! তড়িঘড়ি করে বলল, “ইয়ে মানে… হ্যাঁ দিদিমণি, মানে না দিদিমণি, মায়ে ইয়ে আমি বল… মানে ইয়ে … মানে আমি ঠিক বলও নই…মানে বল দেখলে আমি কিরকম দুর্বল বোধ করি… ইয়ে মানে…”
এক ধমক দিয়ে বাঘুকে থামাল শিয়ালনি, “বাঘু! তোকে এবার আরও দুর্বল করার ব্যবস্থা করছি! চল হতভাগা! একদম আমার পাশে ঠায় বসে পড়াশোনা করবি।”
বলেই বাঘুর লেজ ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে গেল শিয়ালনি। পেছন পেছন গেল বাকিরাও।

পরের সময়টা বাঘুর জন্য মোটেই সুখকর হল না। বিস্তর বদখত ভগ্নাংশের অঙ্ক বাঘুর জন্য আলাদা করে হোমটাস্ক দিয়েছিলেন দিদিমণি! কী কী সব অঙ্ক! একটা অঙ্ক ছিল- তুমি নেমন্তন্ন বাড়ি গিয়ে তোমার পেটের ২/৫ অংশ ফুচকা খেয়ে ভরালে, ১/৩ অংশ ভরালে পকোড়া খেয়ে, ১/৫ অংশ ভরালে ফলের রস খেয়ে। তাহলে তোমার পেটের আর কত অংশ আসল খাবারদাবার খাওয়ার জন্য পড়ে রইল?
তা এইসব অঙ্ক দেখলে কার না রাগ হয়? এসব ফুচকা পকোড়া হাতে ধরিয়ে প্রশ্ন করলে বাঘু যাহোক দেখেশুনে উত্তর দিতে পারত! আর উত্তর ভুল হলেও ফুচকাটা অন্ততঃ পেটে থাকত!
নিতান্ত রেগেমেগেই বাঘু উত্তর লিখল- আমার পেট ভীষণ রকমের উদার। যত খাবারই আসুক, সকলকেই সাদরে বরণ করবে!
কিন্তু এর পরের অঙ্কেই বাঘু পড়ল বেজায় ফাঁপরে। অঙ্কটা ছিল এইরকম- ধরা যাক, একটি থাবাবল খেলায় অংশগ্রহণকারী একজন খেলোয়াড়ের লেজে মোট ১০০টি কালো চুল ছিল। খেলায় ‘আউলে’র ফলে তার ১/১০ অংশ ছিঁড়ে পড়ে যায়। অবশিষ্ট যা চুল ছিল, তার ১/১০ অংশ সে সাদা রঙ করে। তার পরওঅবশিষ্ট যা কালো চুল ছিল, তাই দিয়ে সে প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়ের সঙ্গে চুলোচুলি করে। সে কতগুলি কালো চুল দিয়ে চুলোচুলি করেছিল?
ইচ্ছে হল বাঘুর, এক কিলো পরচুলা কিনে দিদিমণিকেই ভেট দেয়! এত চুলচেরা প্রশ্নের কি আছে? কিন্তু নেহাত রাত হয়েছে, আর তার কাছে পয়সাপাতিও নেই, সেই ভেবে সে তার ইচ্ছেটাকে আপাততঃ মুলতুবি রাখল। কিন্তু উত্তর তো কিছু একটা লিখতেই হয়! নইলে খারাপ দেখায়! হাজার হোক, দিদিমণি, তাঁর একটা মানসম্মান আছে! তাই দিদিমণির মানসম্মানের কথা মাথায় রেখে বাঘু খাতায় উত্তর লিখল- খানিকটা চুন কিনে নিয়ে বাকি চুলগুলো চুনকাম করলেই ঝামেলা মিটে যাবে! সেক্ষেত্রে উত্তর হবে, শূন্য কালো চুল। আর চুনের দাম আমি নাহয় মায়ের থেকে চেয়ে পরে দিয়ে দেবো!


আর মোটে একটাই অঙ্ক বাকি! তা এতগুলো উত্তর যখন দিয়ে ফেলেছে বাঘু, বাকিটাও হয়েই যাবে! নাহয় ভুলই হবে, নাহয় আরেক পিস গোল্লাই জুটবে, নাহয় আরেকটু বকাবকিই খাবে। তা সে তো বাঘু এমনিতেও রোজই গোল্লা পাচ্ছে, রোজই বকা খাচ্ছে!
এইসব ভাবতে ভাবতেই বাঘুর বেজায় হাই উঠে গেল, চোখেও ঘুম জড়িয়ে এল। বাধ্য হয়েই বাঘু তার মায়ের পাশে শুয়ে লেপখানার ২/৩ অংশ নিজের দিকে টেনে নিয়ে মায়ের গায়ে থাবাগুলো আরাম করে তুলে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল!

পরের দিন ক্লাসে বাঘুর খাতা দেখতে বসে শিয়ালনির আক্কেলগুড়ুম! একটা একটা উত্তর দেখছে শিয়ালনি, আর তার লেজের চুল পিড়িংপিড়িং করছে, গায়ের লোম চিড়িং চিড়িং করছে, ভুরু ইড়িংবিড়িং করছে, আর কান কিড়িং কিড়িং করছে! আর তার বুকের ভেতরে ধিড়িং ধিড়িং করে কে যেন কত্থক নাচ শুরু করেছে!
সবশেষের প্রশ্নতে এসে শিয়ালনি থমকেই গেল প্রায়। প্রশ্নটা ছিল এইরকম- ষাঁড়মাদন গদাইলস্করি চালে চলতে চলতে দোকানে গিয়ে মোষধুমসোর কাছ থেকে কিছুটা গোবর কিনল। যা গোবর কিনল, তার ১/৪ অংশ ব্রহ্মদত্যি নিয়ে গেল চান করে গায়ে মাখবে বলে। বাকি যে পরিমাণ গোবর রইল, সেটা হাত থেকে পড়ে গিয়ে ষাঁড়মাদন পুরো লেজেগোবরে হয়ে গেল। এখন যে পরিমাণ গোবরে ষাঁড়মাদন লেজেগোবরে হল, তার পরিমাণ যদি ১৫কেজি হয়, তাহলে ষাঁড়মাদন মোট কত কিলো গোবর কিনেছিল?


নেহাতই সোজা অঙ্ক। জটিলতার কোন জায়গাই নেই!সেখানে বাঘু খাতায় উত্তর লিখেছে- ষাঁড়মাদনের নিজের গোবর থাকতে মোষধুমসোর কাছে গোবর কিনতে গেলে এই দশাই হবে! ওর গোবর কেনারই কোন যুক্তি নেই। শুধু শুধু নিজের পয়সা অপচয় করবে আর সুবোধ জন্তুছানাদের দিয়ে ফ্রি-তে অঙ্ক করিয়ে নেবে- অ্যায়সা চালাকি নেহি চলেগা!


সহসা বিকট ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠল শিয়ালনি, “ওরে বাঘু রে! আমার মুখে গোবর না লেপলে তোর কি চলছিল না রে? আমার পাঠশালার পশুয়া হয়ে তুই এইসব খাতায় লিখলি রে বাঘু! ও হো হো হো!!!”
শিয়ালনি বিলাপ করেই যাচ্ছে দেখে হাতুশি হিনিমিনিকে বলল ‘কদলী বটিকা’ বের করে দিদিমণিকে ঝটপট খাইয়ে দিতে। হিনিমিনি সবে দুটো কদলী বটিকা খাইয়েছে, এমন সময় ভেতরে ঢুকল ভালকির মা, ভালকিন।
ভালকিন ভেতরে ঢুকেই তাজ্জব, “কী গো শিয়ালনি, কী চলছে পাঠশালায়? বাইরে থেকে তোমার কান্নামতো গলার আওয়াজ পাচ্ছিলাম- নাটক টাটক শেখাচ্ছিলে নাকি?”
শিয়ালনি একটু থতমত খেয়ে গেলেও কোনমতে সামলে নিল, “ওই আর কী! নাটকই ধরতে পারো!”
ভালকিন কাজের কথায় এল, “তা শুধু নাটক করলেই হবে, না কি পাঠশালায় খেলাধুলোও কিছু হচ্ছে? ভালকির কাছে শুনছিলাম, তোমরা নাকি পাঠশালায় আজকাল খুব থাবাবল খেলছো?”
শিয়ালনি লজ্জা লজ্জা মুখে হাসল, “ওই আর কী! শীতকাল। খেলাটেলা না হলে কি জমে? আর খেলাধূলা না করলে কি আর বুদ্ধিশুদ্ধি খোলে?”
ভালকিন হাসল, “তা বেশ। তা বেশ। ওই নিয়েই একটা কথা বলতে এসেছিলাম। জানো বোধহয়, আমি এখন ‘জানোয়ার ক্রীড়া কর্মকাণ্ডে’র নতুন সম্পাদক। তাই ভাবছিলাম, তোমরা তো থাবাবল খেলছো টেলছো। তা একটা থাবাবল ম্যাচ করলে কেমন হয়?”
শিয়ালনি কিছু বলার আগেই লাফিয়ে উঠল বাঘু, “জব্বর হয়!”
বাকিরাও হইহই করে লাফিয়ে উঠে নেচেকুঁদে একাকার! শিয়ালনি মুখ কুঁচকোল, “ওরা খেলুক! আমি কিন্তু খেলবো না!”
ভালকিন মিটিমিটি হাসল, “আহ্-হা! তুমি খেলবে কেন? তুমি হবে জেফারি! খেলার নিয়মকানুন তোমার চাইতে ভালো আর কেই বা বোঝে?”
হিনিমিনি জিজ্ঞেস করল, “ভালকিনমাসী, জেফারি কী গো?”
ভালকিন উত্তর দেবার আগেই জবাবটা দিয়ে দিল ভালকি, “আরে, এটাও বুঝলি না? মানুষদের খেলায় যেমন রেফারি থাকে, আমাদের তেমন জেফারি। মানুষের দেওয়া নাম আমরা নিই না কিনা!”

একথা সেকথা নানা কথার পর ভালকিন চলে গেল একসময়। পাঠশালাও ছুটি হয়ে গেল একটা সময়। খালি সবাই চলে গেলে দিদিমণির গলা ধরে ঝুলে পড়ল বাঘু, “ও দিদিমণি, আমাকে ম্যাচে জিতিয়ে দেবেন, কেমন? ও আমার মান্তু দিদিমণি, ও আমার পান্তু দিদিমণি গোও-ও-ও!”

কয়েকদিনের মধ্যেই বনের আনাচেকানাচে নানা ধরনের পোস্টার ঝুলতে দেখা গেল। সবকটারই বয়ান মোটামুটি এরকমঃ-জঙ্গলের জন্তু-জানোয়ারেরাও উত্তেজনার আঁচে ফুটছে। এরকম থাবাবল প্রতিযোগিতা হালফিলের মধ্যে হয় নি। তাও খেলবে আবার কারা? না, শিয়ালনির পাঠশালার পশুয়ারা (পশুয়া= পশু + পড়ুয়া)! শোনা যাচ্ছে, আশপাশের জঙ্গলের জন্তুরাও নাকি আসছে।


দেখতে দেখতে খেলার দিন এসেও গেল। ২নং ধুন্ধুমার পথ যেখানে শেষ হচ্ছে সেখানেই ‘বেপরোয়া মাঠ’। লাল-নীল সবুজ- হলুদ নানা পতাকা উড়ছে মাঠের চারদিকে। গাছে গাছে রকমারি বেলুন। মাঠের চারিধারে মেলা বসে গেছে। একটা বুড়ো বাঘ গলায় হরেক কৌটো ঝুলিয়ে ‘লেবু লজেন্স’ ‘ঝাল লজেন্স’ বলে চেঁচাচ্ছে। একটা ছোকরা গোছের সজারু মুখে একটা নল লাগিয়ে বুদ্বুদ ওড়াচ্ছে। একজন মাঝবয়সী মহিলা শিম্পাঞ্জি নানারকম রুমাল বের করে ম্যাজিকের খেলা দেখাচ্ছে। কাছুয়াও আছে ভিড়ের মধ্যে। সে ‘ডাকসাইটে ডাকঘর’ নাম দিয়ে নানা ধরনের স্ট্যাম্প, রঙিন খাম, চিঠি লেখার কাগজ এসব বিক্রি করছে! ‘জানোয়ারের মুখে বুলি, খাও সবে হজমি গুলি’, ‘খেলে এই কলার কাসুন্দি, খুলেই যাবে জব্বর ফন্দি’- এরকম নানা কথা উড়ছে, ভেসে ভেসে মিশে যাচ্ছে জঙ্গলের পড়ন্ত বেলার বাতাসে।
এইসব চলতে চলতেই মাইকে ভালকিনের গলা ভেসে এল-“হে সমবেত ভদ্র জানোয়ারগণ! অনুগ্রহ করে সকলে নিজ নিজ স্থানে উপবেশন করুন। আমাদের আজকের এই থাবাবল প্রতিযোগিতা আর কিছুক্ষণের মধ্যে শুরু হতে চলেছে! আপনাদের সকলকে জানানো হচ্ছে যে আপনারা খেলা চলাকালীন কলা খেতে পারেন, কিন্তু খোসাটি নিজ নিজ লেজে বেঁধে রাখবেন, যাতে পরিবেশ দূষণ না হয়! কলা ব্যতীত অন্য খোসা সহ ফল না খাওয়াই বাঞ্ছনীয়। আমাদের থাবাবল প্রতিযোগিতার জেফারি শিয়ালনি সহ অন্যান্য প্রতিযোগীরা, যথা হাতুশি, হিনিমিনি, কুমরু, ভালকি এবং বাঘু মাঠে নামছে-এ-এ-এ! সকলকে অনুরোধ করা হচ্ছে করতালি দিয়ে আমাদের এই নবীন পশুয়াদের অভিনন্দিত করুন!”


তুমুল হাততালির ঝড় উঠল একটা! শিয়ালনির পিছু পিছু পশুয়ারা রঙবেরঙের জার্সি পরে ধুপধাপ লাফাতে লাফাতে ঢুকল মাঠে! সবারই লেজ সুন্দর করে গুটিয়ে রঙিন কাপড় দিয়ে খোঁপার মতন করে বাঁধা, যাতে লেজে লেগে ‘আউল’ না হয়!


মাইকে ভালকিনের ভালকিনের গলা শোনা গেল- “সমবেত ভদ্র জানোয়ারদের জানানো হচ্ছে যে পশুকুলের জাতীয় সঙ্গীত আরম্ভ হবে। আপনারা সকলে সামনের সারির ডানপায়ের থাবা তুলে আমাদের জাতীয় সঙ্গীতকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করুন!”


জন্তুরা সেইমতো উঠে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই শুরু হয়ে গেল জাতীয় সঙ্গীত-

আমরা জানোয়ার! সুখী পরিবার!
ধরো থাবা এর তার, লেজ টানো পাবে যার,
খুনসুটির ফলাও কারবার-
আমরা জানোয়ার! সুখী পরিবার!

ঝড়ে-জলে-রোদে জ্বলে
আছি টিকে ফুলে-ফলে,
মিলেমিশে দলে দলে-
আমরা জানোয়ার! সুখী পরিবার!

মন যদি পোড়ে তবু,
রাগ-দ্বেষ হলে কভু,
খাই নাকো হাবুডুবু-
আমরা জানোয়ার! সুখী পরিবার!

জাতীয় সঙ্গীত শেষ হতেই প্যাঁ প্যাঁ প্যাঁ প্যাঁ বাজনা আর চটাপট চটাপট হাততালির বন্যা।ফুররর করে বাঁশি বাজিয়ে খেলাশুরুর সংকেত দিল শিয়ালনি।
কে প্রথমে গোলকিপার হবে সেটার জন্য শিয়ালনি প্রতিদিন নতুন নতুন ছড়া বানিয়ে গোনে। আজ শিয়ালনি ওদের পাশে দাঁড় করিয়ে গুনল-


ইন পিন খেলার টিন!
বলে থাবা, তা ধিন ধিন!
থাবার চোটে ঢুকবে জালে,
তুই এবার যা রে গোলে!


দেখা গেল, কুমরু আউট! কুমরু আবার বেশ একটা চকরাবকরা জার্সি পরেছে! গলায় একখানা জবরদস্ত বেগুনিরঙাগামছা। উদ্যোক্তাদের তরফেই দেওয়া! তার পিঠে জার্সি নম্বর লেখা- ১০০। বাঘু এক হাঁক দিল, “বুঝলি কুমরু, তুই আজ ১০০ গোল খাবি!”
কুমরু গোলের দিকে যেতে যেতেই উত্তর দিল, “অত হাসির কিছু নেই, বাঘু! একটু পর তুইও গোলে আসবি! তখন দেখা যাবে!”
কিন্তু খেলা শুরু হতে দেখা গেল, বাঘু মোটে খেলতেই পারছে না। হাতুশি হিনিমিনি আর ভালকি মিলে বল কাড়াকাড়ি করে খেলছে আর ধাঁইধাঁই গোল দিচ্ছে। হিনিমিনির নেওয়া একটা শট বাঁচিয়ে দিয়ে কুমরু খেলায় চলে এল, ভালকি গেল গোলে! খেলছে সবাই, বাঘুই খালি পিছিয়ে পড়ছে। হাতুশিও গোটা দশেক গোল করে ফেলল।
খেলা চলছে, দর্শকেরাও দেখছে। তা থাবাবল খেলায় যেমন হয় আর কী, এ ওর জার্সি ধরে টানা, হালকা ঠেলা- এসবও চলছে।
এক বিদেশি প্যাঙ্গোলিন দম্পতিও এসেছেন খেলা দেখতে। মহিলাটি সানগ্লাস মাথার উপর তুলে বললেন, “বড্ডো হিংসাত্মক ব্যাপারস্যাপার!”
পুরুষটি সায় দিলেন, “ডিসিপ্লিনের অভাব!”


এদিকে বাঘু হাঁফিয়ে উঠল একটু পরেই। ভালকি গোলে শট নিতে যাচ্ছিল, দুম করে তাকে জড়িয়ে এলোপাথাড়ি কাতুকুতু দিতে শুরু করল। কাতুকুতুর চোটে ভালকি মাটিতে পড়ে যেতেই বাঘু বলে শট নিয়ে গোল করে দিল!
শিয়ালনি ছুটে এসেছে, “বাঘু এটা কী হল? এটা আউল! যা, তুই এবারে গোলকিপার হবি!”
বাঘুই কি আর ভালো কথা মেনে নেবার পাত্র? সে কাঁইমাঁই জুড়ল, “আউল কেন হবে, দিদিমণি? আমি ওকে মারিওনি, পিটিওনি, ওর টিফিনও কেড়ে খাইনি।”
শিয়ালনি মহা খচিতং হয়ে বলল, “বাঘু! জন্তু হাসাসনি, বুঝেছিস? আশপাশের জন্তুরা কী ভাববে বল তো?”
বাঘু গোঁজ হয়ে গোলে দাঁড়াতে গেল ঠিকই, কিন্তু গজগজ করতেও ছাড়ল না, “উনি জেফারিমিস হবেন, আর যা খুশি ফরমান দেবেন, আর বাঘু বেচারিকেই সব মেনে চলতে হবে! বাঘুর বেলাতেই যত একচোখোমি! বাঘুকে উনি ক্লাসের পড়াতেও গোল দেবেন, খেলাতেও দেবেন! বাঘুরই বরাত!”
শিয়ালনি শুনতে পেয়েছে বাঘুর কথা। সেও চেঁচাল, “দ্যাখ বাঘু, কষ্ট করে যখন গুরুজন হয়েছি আর জেফারি মিস হয়েছি, তখন আমার কথা শুনে চলতে হবে। বুঝেছিস?”
এই বলে শিয়ালনি ফের খেলা শুরু করিয়ে দিল। বাঘু বেজার মুখে গিয়ে দাঁড়াল গোলের সামনে আর একের পর এক গোল খেতেই থাকল। হাতুশি, হিনিমিনি, কুমরু, ভালকি- যে যা পারছে শট নিচ্ছে আর ধাঁই ধাঁই করে গোল হচ্ছে তো হয়েই যাচ্ছে!


গোলপোস্টের ঠিক পিছনটাতেই একটা ঝোপমতো। বাঘু একবার দুম করে সেই ঝোপের দিকে গেল আর একটা বালিশ নিয়ে ফেরত এল। তারপর গোলপোস্টের সামনে থাবার উপর থাবা তুলে দিয়ে চিৎপাত হয়ে বালিশে মাথা দিয়ে আরাম করে শুল। মাঠজুড়ে হাসির হররা উঠল একটা।


শিয়ালনি হাঁইহাঁই করে ছুটে এসেছে, “এটা কী হচ্ছে, বাঘু? গোলপোস্টটা শোবার জায়গা?”
বাঘু মিটিমিটি হাসল, “কেন দিদিমণি বেশ ভালো জায়গাই তো। আপনিও পাশে শুয়ে পড়ুন না!”
শিয়ালনি বিশ্রী রকমের মুখভঙ্গি করে বাঘুর দিকে তেড়ে গেল, “বাঘু, ওঠ, ওঠ, বলছি! দেখছিস না, সবাই কেমন হাসছে!”
বাঘু মিটিমিটি হাসল, “হাসছে তো দিদিমণি। কাঁদছে তো আর না। আর হাসা শরীরের পক্ষে ভালো। আপনিই বলেছেন ক্লাসে।”
শিয়ালনি কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল, “ওরে, এ হাসা সে হাসা নয়!”
বাঘু বলল, “দিদিমণি, হাসি তাহলে কত রকমের হয় ও কী কী প্রকার?”
শিয়ালনি বাঘুর মাথার তলা থেকে বালিশটা কেড়ে নিয়ে বাকিদের ডাকল, “তোরা এসে বাঘুকে ধরে তুলে দে তো!”
তুমুল হাততালির গর্জন উঠল দর্শকদের মধ্যে। ময়ূরাট নর্তনসম্রাটও ছিল ভিড়ের মধ্যে। সে তার পাশে বসা সজারু ঝালমুড়ু-র থেকে একঠোঙা ঝালমুড়ি নিয়ে চিবোতে চিবোতে বলল, “তবে যাই বলো আর তাই বলো, এইরকম খাসা মাঠ পেলে নেচে দেখিয়ে দিতুম! নেহাত এখন বৃষ্টি-বাদলা হচ্ছে না, আর আমারও গা ম্যাজম্যাজ করছে! ভাবলাম, পুঁচকে ছেলেমেয়েগুলো খেলতে চাইছে, খেলুক!”
সজারু ঝালমুড়ু তার কথায় কোন পাত্তাই দিল না! কারণ বাঘুকে চ্যাংদোলা করে তোলা হয়েছে বটে, কিন্তু সে শিবনেত্র হয়ে গ্যাঁট হয়ে গোলের সামনে বসে পড়েছে! ভাবখানা এই, তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার গোল খাওয়া চাই!
শিয়ালনি আবার তেড়েফুঁড়ে ছুটে গেল। বাঘুর সাফ কথা- আমি এমনিতেও গোল খাবো, অমনিতেও গোল খাবো। শুধুশুধু কেন কষ্ট করি?
শিয়ালনি প্রায় কেঁদেই ফেলে আর কী, “বাঘু! অমন করিস না। পাঠশালার মানসম্মানের কথা একটাবারও ভাববি না?”
পাঠশালার মানসম্মানের কথায় বাঘুর অল্প হলেও টনক নড়ল। হেলতে দুলতে উঠে দাঁড়াল বাঘু। তারপর কোমরে থাবা দিয়ে দাঁড়াল গোলের সামনে।
খেলা শুরু হল আবার। বাঘু এক দুটো গোল বাঁচানোর চেষ্টা করছে বটে, কিন্তু বিশেষ সুবিধে করতে পারছে না। দিদিমণি কাছে আসতে আবদারও জুড়ল বাঘু, “দিদিমণি, ওদের কাউকে আউল টাউল দিন না! আমিও একটু গোল-টোল করি!”
শিয়ালনি পাত্তা না দিতে বাঘুর গোঁসা হল বেজায়। মুখে কিছু বলল না বটে কিন্তু ভেতরে ভেতরে যে সে মতলব একটা এঁটেই ফেলেছে সেটা বোঝা গেল একটু পরেই।


দূরে মাঠে বল কাড়াকাড়ি চলছে। সবার নজর সেদিকেই। বাঘুকে তত কেউ খেয়াল করছে না।বাঘু এগিয়ে গেল বেশ খানিকটা সামনের দিকে। দর্শকেরা ভাবল, বাঘু বুঝি গোল বাঁচানোর উদ্যোগ নিয়েছে! আর বাঘু করল কী, প্যান্টের পকেট থেকে কাপড়ে জড়ানো একটা প্যাকেট বের করল। তারপর প্যাকেটের কিসব জিনিস সামনের চুনকাটা দাগ বরাবর ছড়িয়ে দিল।
তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দমাস করে মারা হাতুশির একখানা শট গোলার মতো এসে জালে জড়িয়ে গেল। দর্শকেরা ওদিক থেকে চিৎকার করে উঠেছে- গো-ও-ও-ল! বাঘু দাঁড়িয়ে ছিল চুনকাম করা লাইনের কাছে। সেখান থেকেই থাবা তুলে চেঁচাল, “খবরদার! কেউ কাছে আসবি না! এখানে কাঁচের টুকরো ছড়ানো আছে। কেউ আসার চেষ্টা করলেই পায়ে কাঁচ ফুটে যাবে! বলে দিলাম কিন্তু!”
থমথমে একটা অবস্থা মাঠে। মহিলা প্যাঙ্গোলিনটি বললেন, “আউ! কাঁচ? কী ভয়ানক!”
পুরুষ প্যাঙ্গোলিন সায় দিলেন, “বালকবাঘ কর্তৃক হিংসা! ডিসিপ্লিন নাই!”
বাঘু ওদিকে ততক্ষণে পকেট থেকে একটা চোঙা বের করে বলতে শুরু করেছে, “নমস্কার সকলকে! এবারে আপনারা দেখতে থাকুন বাঘুর কেরামতি! এইবারে… গোল দেবেন বাঘুবাবু!”
বলেই বাঘু যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখান থেকেই এক শট মারল গোলে। বল গিয়ে সোজা জড়িয়ে গেল জালে।
শিয়ালনি চেঁচাচ্ছে ওদিক থেকে, “আউল! আউল! এই গোল ভুল!”
কে শোনে কার কথা? বাঘু গোল মিস করছে মাঝেমাঝেই, কিন্তু তারই মধ্যে গোল হয়েও যাচ্ছে। ছানাপোনা জন্তুজানোয়ারেরাও এসেছে বিস্তর। তারা উৎসাহ পেয়ে চেঁচাচ্ছে- বাঘুদাদার গোল! বাঘুদাদার গোল!


শিয়ালনি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছে মাঠেই। ভালকিন ছুটে ছুটে আসছে। আর ছুটে এগিয়ে এল সজারু ঝালমুড়ু। এসেই বলল- “দিদিমণি, কিচ্ছু চিন্তা করবেন না আপনি।আমার কাঁটা দিয়ে সব কাঁচ আমি ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দিচ্ছি। তারপর আপনি যা করার করুন।”
বলতে বলতেই সব কাঁচ ঝেঁটিয়ে সাফ করে দিল সজারু ঝালমুড়ু। “দিদিমণি, এবারে যান ওদিকে। আর ভয় নেই।”


বাঘু এতক্ষণ মনের আনন্দে একের পর এক গোল করেই যাচ্ছিল। দিদিমণিকে ঊর্ধ্বশাসে এগিয়ে আসতে দেখেই একখানা ডিগবাজি খেয়ে বলটাকে জোরে চেপে ধরে চোঙাটাকে বাগিয়ে কান্না জুড়ে দিল, “ওরে আমার এ কী হল রে… আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না)…সবকটা গোলই আমার গোল্লা পেল বোধহয় রে… আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না)… ও দাদারা, দিদিরা, মাসিরা, মেসোরা, জেঠুরা, জেঠিমারা, আপনারা সবাই মিলে দিদিমণিকে একটু বোঝান না গো… আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না)…আমি তো আপনাদের আনন্দ দিলাম না কী গো…আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না)…আপনারা সবাই অমন পাষাণ হলে বাঘু কী করে গো… বাঘুর কী কপালে গোলই লেখা গো… আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না)…আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না) ……।

………০………

অংকনঃ পুণ্যতোয়া ধর

বাঘু সিরিজের অন্যান্য গল্পগুলি থাবাছানি দিচ্ছে নিচের লিঙ্কেঃ-

১। বাগে এলো বাঘু

২। গিঁটের গেরোয় বাঘু

৩। বাঘু খেল ঘাস

৪। বাঘু হলেন মনিটর

৫। শিয়ালনী কুপোকাত

৬। অযোধ্যা পাহাড়ে বাঘু 

৭। পরীক্ষা দিলেন বাঘু

৮। গণ্ডারনী ও গণ্ডগোলিক্স

৯। নামতা শেখেন বাঘুবাবু

১০। শিয়ালনীর পাঠশালায় সিংহালু

১১। বাঘু হল চিৎপটাং 

১২। ঘুম দিলেন বাঘুবাবু  

১৩। পাঠশালায় ধুন্ধুমার

১৪। বাঘুবাবু ও জান্তা জট 

১৫। বনভোজনে বাঘুবাবু

১৬। হোলি খেলল হিনিমিনি      

১৭। ভোটে দাঁড়ালেন বাঘুবাবু

১৮। পাঠশালা মহাসভায় হাতুশি 

১৯। বাঘুর ল্যাজলজ্জা

২০। ছবি আঁকেন বাঘুবাবু         

২১। জানোয়ার বার্তা ও বাঘুবাবু

২২। উল্কার কবলে বাঘু

২৩। কবি সম্মেলনে বাঘুবাবু

২৪। বিদেশি মোলাকাতে বাঘু

Leave a comment

Check Also

সেই সব শীতকাতুরেরা

সেই সব শীতকাতুরেরা – সোমক সেনগুপ্ত

[ সে এক সময় ছিল বটে! ভিনগ্রহী জীব তবু হয়তো কল্পনা করা যেত- কিন্তু মোবাইল …

একুশে ফেব্রুয়ারি

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো : একটি গান ও দুই বাংলার মিলনসেতু – বদরুদ্দোজা হারুন

[ভাষা শহীদ আবুল বরকতের ৯৬ তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে লেখা l]   “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো …

মৃত্যুর কবিতারা- সুদীপ্ত বিশ্বাস

১ লাশ কাটা ঘর – সুদীপ্ত বিশ্বাস একদিন আমার বদলে বিছানায় শুয়ে থাকবে আমার লাশ। …

দর্পণে

দর্পণে – নির্মাল্য ঘরামী    

    -চল, আমি জোরের সঙ্গে বললাম, -ওসব একদম ভাবিস না। তোকে এতদিন পরে পাচ্ছি, …