Home / গল্প / দর্পণে – নির্মাল্য ঘরামী    

দর্পণে – নির্মাল্য ঘরামী    

দর্পণে
শিল্পী- দেবলীনা রায়

 

 

-চল, আমি জোরের সঙ্গে বললাম, -ওসব একদম ভাবিস না। তোকে এতদিন পরে পাচ্ছি, এটা কি কম সৌভাগ্য?

-টিটকিরি দিস না ভাই, ছোটকা কিছুটা বিরস বদনে বলল, -আমার একটু অসুবিধে আছে। আমি যেতে পারব না।

-কিচ্ছু অসুবিধে নেই তোর। আমি একটু রাগত স্বরেই বললাম, -ওসব নাটক আমাকে দেখাস না। তুই আমার ওখানে যাবি- ব্যস এটা ফাইনাল।

-নারে ভাই। ছোটকা কিছুটা জেদের সঙ্গে বলল, -আমি যেতে পারব না। এ ক’দিন ব্যবসার ব্যাপারে আলোচনা করতে কয়েকটা জায়গায় যেতে হবে। মোদো-র সঙ্গেও বসতে হবে।

-ওকেও ডেকে নে। আমি ওর কথাটা ওর দিকেই ঘুরিয়ে দিলাম, -সেই দায়িত্ব তোকেই দিলাম। আমাদের বাড়িতে এসেই না হয় সেদিন আলোচনাটা সেরে নিস।

-সত্যিই কি তুই চাস আমি তোর ওখানে যাই?

কথাটা বলে যে দৃষ্টিতে ছোটকা মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল, সেই দৃষ্টির দর্পণে আমি নিজেকেই যেন দেখতে পেলাম, শুধু কয়েকটা বছর পিছিয়ে যেতে হল।

 

তখন দূরের কলেজে পড়ি। পকেটে নিতান্ত অর্থাভাব। এদিকে খরচ করলে ওদিকে টান পড়ে। তা সেবারে পুজোর সময়ে কয়েকজন মিলে ঠিক করল রাতে মণ্ডপে জাগবে। ওখানেই পিকনিক হবে। সারারাত আড্ডাও চলবে। আমিও অনেকটা রবাহুত হয়ে ওদের দলে জুটে গেলাম। রাতে জমিয়ে খাওয়া-দাওয়ার পরে মণ্ডপের পিছনে তাসের আড্ডা তখন জমে উঠেছে। হঠাৎ করেই মোদো প্রস্তাব দিল,

-আজ একটু বিয়ার না খেলে ঠিক জমছে না। শরীরটা কেমন যেন শুকিয়ে যাচ্ছে।

-মোমকে না পেলে পাতি বিয়ারে তোর কিছুই হবে না। লঙ্কা টিপ্পনি কাটল।

-মারব শালা থাপ্পড়! মোদো রাগতস্বরে বলল, -শুধু কাঁচা জায়গায় ঘা দিস। তোর তিন্নির কথা ভাব।

-সে তো আমি ভাবব। লঙ্কা ছেড়ে দেওয়ার পাত্র না। সে বলল, -তার কথা ভেবে শালা তোর লাভ?

-থাম, থাম হয়েছে। ছোটকার মধ্যে কিছুটা নেতৃত্বসুলভ বৈশিষ্ট্য আছে। গলাটা একটু চড়িয়ে সে মধ্যস্থতা করে বলল, -বিছানায় শুয়ে শুয়ে নিজেদের মালের কথা ভাবিস। এখন বিয়ারের কথাটা ভাব।

-তুই মাল বললি? লঙ্কা নাছোড়বান্দা প্রকৃতির। সে ছোটকার দিকে তাকিয়ে বলল, -ওকে আমি বিয়ে করব।

-তাতে আমাদের কী? বেল পাকলে কাকের কী? গেল বছর ছিল সুন্টি, এইবছর হল তিন্নি, সামনের বছর…………

কথাটা অসমাপ্ত রেখে ছোটকা এমন গোল-গোল, ড্যাব-ড্যাবে মুখে তাকাল যে লঙ্কা নিজেকে গুটিয়ে নিল। লঙ্কাই বলল শেষে,

-তাহলে বিয়ারের ব্যাপারটা দ্যাখ।

-দ্যাখাদেখির কিছু নেই। ওই বাস স্ট্যাণ্ডে যেতে হবে। মোদো বলল, -ভুটকা’র পানের দোকান সারা রাত খোলা থাকে। ও শালা ব্ল্যাকে মাল বেচে।

-ঠিক আছে। লঙ্কা বলল, -কোন অসুবিধে নেই। দু’টো করে বোতল নিয়ে আসব। রাত শেষ হতে এখনও অনেক বাকি।

দু’খানা বোতল, তাও ব্ল্যাকে! শুনেই আমার ততক্ষণে হয়ে গেছে। আজ হোটেল থেকে জম্পেশ করে খাবার আনিয়ে রাতে আমরা খেয়েছি। পকেটে আর বিশেষ কিছু নেই। কিন্তু সেটা নিজে থেকে বলতেও সঙ্কোচ হচ্ছে। দু’দিন আগেই বাবার থেকে টাকা নিয়েছি। এবারে চাইলে নির্ঘাত তেড়ে আসবে। আমার আশঙ্কা ছোটকা মনে হয় টের পেয়েছিল। সে গলা চড়িয়ে মোদো-লঙ্কাকে বলল,

-পিন্টুর টাকাটা আমি দিয়ে দিচ্ছি। তোদের টাকা বের কর। আমি মণ্ডপ থেকে পুরুত ঠাকুরের ফেলে যাওয়া ফাঁকা ব্যাগটা নিয়ে আসছি। তোরা দু’জনে গিয়ে মাল নিয়ে আয়।

বলেই উঠে মণ্ডপের দিকে চলে গেল ছোটকা। একটু পরেই একটা বাজারের ব্যাগ হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে এল। তারপরে পকেট থেকে দুটো করে একশ’ আর দশ টাকার নোট বের করে মোদোকে দিয়ে বলল, -খবরদার, দশ টাকার বেশি বোতলে এক্সট্রা দিবি না।

স্ট্রীট লাইটের আলোতে অপসৃয়মান লঙ্কা আর মোদোকে দেখতে দেখতে আমি হঠাৎ করেই ছোটকাকে বলে ফেললাম,

-ভাই টাকাটা ধার হিসেবেই দিস। আমি ক’দিন পরে তোকে দিয়ে দেব।

-ছাড় তো ওসব। ছোটকার গালের কাছে একটা মশা ঘুর ঘুর করছিল। সেটাকে তাড়িয়ে দেবার মতন হাতের ভঙ্গি করে ও বলল, -তুই এখনও স্টুডেন্ট। আমি কামাচ্ছি। একদিন তোকে খাওয়ালে আমার পয়সা কমবে না।

ঠিক এইসময়ে আমি ছোটকার দিকে কেমন একটা খুশী, অবাক, হতভম্বের মতন দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলাম- আমার স্পষ্ট মনে আছে।

 

ছোটকা’র টেলিফোন বুথের ব্যবসা কালের নিয়মে উঠে গেছে। আমার বাড়িতে বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে গেট-টুগেদারের একটা অনুষ্ঠান করব বলে ক’দিন থেকে ভাবছিলাম। অনেকদিন কোন যোগাযোগ নেই। তা হঠাৎই স্টেশনে দেখা হয়ে গেল ছোটকা’র সঙ্গে। কয়েক বছর আগে সেদিন রাতে আমার মুখের রংয়ের, ভাবের, সামগ্রিক অনুভূতির যে পরিবর্তন হয়ে চলেছিল ক্রমান্বয়ে, সেটা আমি টের পেয়েছিলাম। কিন্তু তা দৃষ্টির অগোচরে রয়ে গিয়েছিল। এই এতদিন পরে আজ ছোটকার মুখের দর্পণে অবশেষে নিজেকে দেখতে পেলাম।

++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++

Leave a comment

Check Also

গোল করলেন বাঘুবাবু

বাঘু দিল গো-ও- ও-ল – মৌসুমী পাত্র

  শীতটা এবারে কেমন যেন ল্যাজ গুটিয়ে পালিয়েছে! অন্যান্য বছর কার্তিক মাস পেরোতে না পেরোতেই …

আশমানি পাঠশালা

আশমানি পাঠশালা – ইন্দ্রানী ভট্টাচার্য্য

  ” ডান দিকটা একটু ওপরে উঠে গেছে। নামা। ব্যস, ঠিক আছে। এবার দড়িটা শক্ত …

আত্মারামের বাসর যাপন

আত্মারামের বাসর যাপন – রঘুনাথ মণ্ডল

    আত্মারামের বিয়ে, কনে বিল্ববাসিনী। আগে আত্মারাম কনে দেখেনি। বাবা, মামা সম্বন্ধ করে ঠিক …

সেই সব শীতকাতুরেরা

সেই সব শীতকাতুরেরা – সোমক সেনগুপ্ত

[ সে এক সময় ছিল বটে! ভিনগ্রহী জীব তবু হয়তো কল্পনা করা যেত- কিন্তু মোবাইল …