Home / প্রবন্ধ / মহাশিল্পী রবিশংকর : ভারতের মোৎসার্ট – রঞ্জন চক্রবর্ত্তী

মহাশিল্পী রবিশংকর : ভারতের মোৎসার্ট – রঞ্জন চক্রবর্ত্তী

 

বিশ্বের সংগীতপ্রেমীদের কাছে রবিশংকর ও মোৎসার্ট দু’টি নামই সুপরিচিত। উভয়েই বহুশ্রুত হলেও সংগীতের গভীরে অবগাহন না করলে তাঁদের সুরসৃষ্টির তাৎপর্য সঠিকভাবে বোঝা যায় না। অতএব রবিশংকর ভারতের মোৎসার্ট কি না, সে বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসতে হলে ভারতীয় রাগসঙ্গীত এবং পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সংগীতের সঙ্গে পরিচিত হওয়া প্রয়োজন।

ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীতের অনেক ঘরানা আছে। যেমন – আগ্রা, গোয়ালিয়র, পাতিয়ালা, কিরানা, বিষ্ণুপুর ইত্যাদি। বিভিন্ন ঘরানার আদি পুরুষদের অনেকেরই নাম বিস্মৃতির গর্ভে বিলীন হলেও কোনও না কোনও মহাশিল্পী নিজ নিজ ঘরানাকে গৌরবান্বিত করেছেন। যেমন আগ্রা ঘরানার ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ, কিরানা ঘরানার ওস্তাদ আব্দুল করিম খাঁ প্রভৃতিরা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। রবিশংকর হলেন মাইহার ঘরানার শিল্পী। মধ্যপ্রদেশের সাতনার কাছে মাইহার ছিল ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ-র প্রৌঢ় বয়সের সাধনপীঠ। এইখানেই তিনি দেশের বহু সংগীত-গুণীকে শিক্ষা দিয়েছিলেন। তাঁকে আশ্রয় করেই মাইহার ঘরানার জন্ম। রবিশংকর ছিলেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ-র অন্যতম প্রিয় শিষ্য। রবিশংকর ছাড়াও মাইহারের অসাধারণ প্রতিভাধর শিল্পী ছিলেন আলাউদ্দিন খাঁ-র পুত্র সরোদিয়া ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ, কন্যা অন্নপূর্ণা দেবী এবং সেতারশিল্পী পণ্ডিত নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়।

অন্যান্য ঘরানার শিল্পীদের সঙ্গে রবিশংকরের একটা খুব বড় পার্থক্য আছে। সাধারণত কোনও একটি ঘরানার সংগীত-শিল্পীদের নিজের ঘরানার পারিবারিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার বহন করতে দেখা যায়। যেমন ইমদাদ খানী ঘরানায় (মূলত সেনী) ওস্তাদ ইমদাদ খাঁ, ওস্তাদ এনায়েৎ খাঁ, ওস্তাদ বিলায়েৎ খাঁ, ওস্তাদ সুজাৎ খাঁ প্রভৃতিরা ধারাবাহিকভাবে বংশ-পারম্পরায় সংগীত-বিশারদ রূপে পরিচিত হয়েছেন। একইভাবে ওস্তাদ হাফিজ আলি খাঁন, ওস্তাদ আমজাদ আলি খান, আমান আলি বঙ্গাশ প্রভৃতিরা বংশানুক্রমিকভাবে নিজ ঘরানার সরোদ বাদনের ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। এই ধারাবাহিক বংশগত পারম্পর্য তাঁদের সংগীত সাধনায় ও প্রতিভার বিকাশে সহায়ক হয়েছে। কিন্তু রবিশংকরের ক্ষেত্রে তা হয়নি। তিনি কোনও বিশেষ সংগীত ঘরানার উত্তরাধিকারী বা কোনও বিখ্যাত সংগীতশিল্পীর পুত্র বা নিকটাত্মীয় ছিলেন না। তিনি বিবাহ-সূত্রে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের জামাতা ছিলেন। তবে সেটা রক্তের সম্পর্ক ছিল না। অর্থাৎ তিনি কোনও সাঙ্গীতিক পরিবারের বা বংশের উত্তরপুরুষ ছিলেন না। কিন্তু যে প্রতিভার স্ফুরণ রবিশংকরের মধ্যে দেখা গিয়েছিল সেরকম দৃষ্টান্ত সচরাচর পারিবারিক ধারার মধ্যেই দেখা যায়। বিদেশে মোৎসার্ট বা বেটোফেনও সাঙ্গীতিক পরিবারে জন্মেছিলেন। তাই রবিশংকরের একটা বড় কৃতিত্ব হল তিনি কোনও সাঙ্গীতিক পরিবারের সন্তান না হয়েও একটা সংগীত-ঘরানার ধারা সম্পূর্ণরূপে আত্মস্থ করেছিলেন। অবশ্য যে পরিবারে তাঁর জন্ম ও বড় হয়ে ওঠা সেটিও খুবই সংস্কৃতিবান ছিল। বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী উদয়শংকর ছিলেন তাঁর অগ্রজ।

ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ-র শিষ্য মাইহার ঘরানার সেতার-শিল্পী রবিশংকর সেতারের এমন এক অশ্রুতপূর্ব বাদন-শৈলী সৃষ্টি করেছিলেন যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় যন্ত্রসংগীতে ‘রবিশংকরী বাজ’ নামে প্রতিষ্ঠালাভ করেছিল। ইউরোপীয় ক্লাসিকাল সংগীতের ক্ষেত্রে বেটোফেনের যে অবদান, ভারতীয় ক্লাসিক্যাল সংগীতের জগতে রবিশংকরেরও সেই অবদান। সেতারে ‘ইমদাদ খানী বাজের’ যে সাঙ্গীতিক রূপ ও বাদনশৈলীর সঙ্গে আমরা বরাবর পরিচিত আদতে তা-ই ছিল সেতারের সনাতনী পরিচয়। তার থেকে সেতার বাদনের ঢংয়ে এক বড় পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল ‘রবিশংকরী বাজ’। কিন্তু সেটা কীভাবে? প্রথমত, সনাতনী ধারার সেতারের স্বর-ব্যাপ্তি (range) আড়াই সপ্তকের চেয়ে আরও দু’-তিন স্বর বেশি। সেখানে রবিশংকর এক অতি-মন্দ্র স্বরস্থানের সংযোজন করেছেন, যার ফলে তাঁর সেতারের স্বর-ব্যাপ্তি আরও এক সপ্তক বেশি হয়েছে। তবে এখানেই শেষ নয়। সেতারের তার-স্থানে আরও এক পর্দা যোগ করে তিনি সম্পূর্ণ চার সপ্তকের স্বরব্যাপ্তি সৃষ্টি করেছেন। ফলে আলাপের ব্যাপ্তি যেমন বিস্তৃততর হয়েছে, তেমনই ধ্বনি-বৈচিত্র্য আরও প্রস্ফুটিত হয়েছে।

ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ বীণকর ওস্তাদ ওয়াজির খাঁ-র শিষ্য ছিলেন, এবং ওয়াজির খাঁ ছিলেন তানসেনী ঘরের বংশধর। অতএব বীণকর ওয়াজির খাঁ সাহেবের কাছে শিক্ষা প্রাপ্তির ফলে আলাউদ্দিন-শিষ্য রবিশংকরের সেতারে অনেকটা বীণার গাম্ভীর্য ফুটে উঠেছে। তাঁর আলাপ বা জোড়ের মধ্যে একটা ধ্রুপদী গাম্ভীর্য খুব স্পষ্ট। তবে আমরা যখন তাঁর সেতার-বাদন শুনি তখন বাদনশৈলীর বিভিন্ন আঙ্গিকের থেকেও বেশি করে একটা transcendental চরিত্র ফুটে ওঠে। একই সঙ্গে দেখা যায় একটা spiritual ভাব-স্রোত। আসলে তাঁর সেতারের এমন একটা ভাষা আছে, যার মধ্যে অনেকখানি মানবিক দরদ মেশানো। ভারতীয় যন্ত্রসংগীতের মধ্যে এমন কাব্যিক আবেদন ও নাটকীয় ভাবরূপ বিরল। এই গুণটি তাঁর গুরুভাই আলী আকবর খাঁ-র হাতেও ছিল। নিখিল ব্যানার্জীর হাতেও তা যথেষ্ট ফুটে উঠেছিল। সংগীতের মধ্যে এই নাটকীয়তা ও মানবিক দরদের জায়গাটায় হয়ত তিনি মোৎসার্টের কাছাকাছি চলে আসেন।

ভারতীয় সঙ্গীত থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রের এক সংগীত-জগতে মোৎসার্টের বিচরণ। ভারতীয় সঙ্গীতের মতো ইউরোপীয় সঙ্গীত শুধুমাত্র মেলোডি-নির্ভর নয়। পাশ্চাত্য ক্ল্যাসিকাল সঙ্গীতে মেলডিক সুর নিশ্চয়ই আছে কিন্তু তার ধরন সম্পূর্ণ অন্য রকম। মূলগতভাবে তা ভারতীয় সংগীতের মত মীড়-বহুল ও আলঙ্কারিক নয়। পাশ্চাত্য ক্লাসিকাল সঙ্গীতে মীড়ের জায়গায় আছে কর্ড (chord)। অনেক কর্ডের সমন্বয়ে সৃষ্টি হয় হার্মনি, যার ভিত্তিপ্রস্তর হল ঐ কর্ড। ইউরোপীয় সংগীতের শিক্ষার্থীদের কাছে হার্মনি বলতে বোঝায় দুই, তিন বা তার থেকে বেশি স্বরের সম্মিলিত ধ্বনি। এটাই হল কর্ড, যার সমন্বয়ে হার্মনির সৃষ্টি হয়। এভাবে সম্মিলিত স্বরের বা ধ্বনির মধ্যে অপার সৌন্দর্য নিহিত আছে।

ভারতীয় সংগীতের রাগ-রাগিণী মতো কিছু পাশ্চাত্য সংগীতে নেই। ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীতের ঠাট পদ্ধতির অনুরূপ পাশ্চাত্যে প্রাচীন কালে ছিল modal music। গ্রেসরিয়ান মত অনুসারে Dorian, Phrygian, Lydian ইত্যাদি প্রচলিত ছিল, যা কাফী, ভৈরবী, খাম্বাজ প্রভৃতি ঠাটের কাছাকাছি। কিন্তু বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে সে পদ্ধতি বর্জন করে তাঁরা কেবল major scale (বিলাবল ঠাট) ও minor scale (কিরওয়ানি জনকমেল) গ্রহণ করেন। কারণ এই দু’টি স্কেলই হার্মনিক সঙ্গীতের পক্ষে সব থেকে উপযুক্ত। বিভিন্ন ভাব অনুসারে বা বিষয়োচিত প্রয়োজনে বিভিন্ন হার্মনিক আধারে কোমল ও তীব্র স্বর তাঁরা যেখানে-সেখানে ব্যবহার করতে পারেন।

পাশ্চাত্য ক্লাসিকাল সঙ্গীতে কর্ড ব্যতীত শুদ্ধ মেলোডি সৃষ্টি নির্ভর করে ব্যবহৃত স্বরগুলির পারস্পরিক হার্মনিক সম্পর্কের উপর। এ ছাড়াও আছে একটা ধারাবাহিকতার উপর স্কেল পরিবর্তন। কতকগুলি বিশেষ নিয়ম অনুসারে (key modulation) সা-এর স্থান স্বর থেকে স্বরান্তরে পরিবর্তিত হয়। সম্পূর্ণ কম্পোজিশনটি রচিত হয় কোনও নির্ধারিত স্কেলে। অর্থাৎ Symphony in B-flat মানে, এর সা B-flat key-র উপর। Sonata in G-major কথার অর্থ হল এর সা G-এর key-তে। পাশ্চাত্য সংগীতে স্থায়ী অন্তরার জায়গায় আছে থিম (theme) পরিবর্তন। সেটি মন্দ্র, মধ্য, তার, অতিমন্দ্র, অতি-তার স্থানেও হতে পারে। পাশ্চাত্য যন্ত্রসংগীতে স্বরব্যাপ্তি (range) পিয়ানোয় সাত সপ্তক পর্যন্ত। তবে অর্গ্যান বা একটি সম্পূর্ণ ফিল-হার্মনিক অর্কেস্ট্রায় তা আটও হতে পারে। একটা সম্পূর্ণ কম্পোজিশন দুই বা ততোধিক থিম বা সাবজেক্টের সমন্বয়ে গঠিত হয়। ধরা যাক ভারতীয় রাগমালার অনুরূপ হল পাশ্চাত্যের থিম-মালা। বিবিধ ভাব ও ধ্বনিবৈচিত্র্যের মধ্যে দিয়ে এই সঙ্গীত-সৃষ্টি উন্নত শৈল্পিক মানের না হলে তা সুধীজনের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। পাশ্চাত্য সঙ্গীত জগতের অনেক দিকপালের সুরসৃষ্টিই এই বৈচিত্র্যের গুণে তাৎপর্যপূর্ণ। বাখ, বেটোফেন ও মোৎসার্ট তাঁদের মধ্যে অন্যতম।

পাশ্চাত্য সংগীতে সপ্তদশ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ পর্যন্ত সময়কালকে বলা হয় পলিফনিক (polyphonic) বা ক্লাসিকাল যুগ। তারপর শুরু হয়ে রোমান্টিক যুগ। এই দুই যুগের সন্ধিক্ষনে দাঁড়িয়ে আছেন লুডউইগ ভ্যান বেটোফেন। প্রকৃতপক্ষে তাঁরই প্রবর্তিত স্টাইলকে আশ্রয় করে রোমান্টিক যুগের সূচনা। হেক্টর বার্লিওজ, ফ্রেডেরিক শোপ্যাঁ, রবার্ট শুম্যান প্রভৃতিরা হলেন রোমান্টিক যুগের জ্যোতিষ্ক। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে ক্লদ দেবুসি, মরিস রাভেল প্রভৃতির হাতে পুষ্ট হয় রোমান্টিক যুগ। এই যুগে সমসাময়িক আর্টের জগতের সঙ্গে তাল রেখে সংগীতের শাস্ত্রীয় বিধি নিয়মের মধ্যে সুরস্রষ্টারা চরম বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসেন, যা নিশ্চিতভাবেই নবযুগের বার্তা বহন কর। চিত্রশিল্পের ক্ষেত্রে ভ্যান গখ্, মাতিস বা রুসো যে বিপ্লব এনেছিলেন সংগীতের ক্ষেত্রে দেবুসি, শোয়েনবার্গ, স্ত্রাভিনস্কি প্রমুখরা অনেকটা সেরকমই বিপ্লব এনেছিলেন। তবে প্রথম দিকের সুরস্রষ্টাদের মধ্যে মোৎসার্টের পর সবচেয়ে বড় বিপ্লবী ছিলেন বেটোফেন। তদানীন্তন সংগীতের বিধিবদ্ধ শাস্ত্রীয় বেড়াজাল থেকে তিনি একজন যথার্থ বিদ্রোহীর মতো বেরিয়ে এসেছিলেন।

পলিফনিক যুগের ক্লাসিকাল সংগীত তার চরম সৌন্দর্যময় রূপ পরিগ্রহ করেছিল উলফগ্যাং আমেদিওস মোৎসার্টের হাতে। তাঁর জন্ম ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জানুয়ারী। মোৎসার্ট স্বল্পায়ু ছিলেন, মাত্র ৩৫ বছর বেঁচেছিলেন। তাঁর সঙ্গীত জীবন শুরু হয়েছিল পাঁচ বছর বয়স থেকে আর শেষ রচনা মৃত্যুশয্যায় শুয়ে। এই সংক্ষিপ্ত জীবনকালে তাঁর রচিত সুর সত্যিকারের ক্লাসিক্যাল মানের আর্ট। মোৎসার্টের সঙ্গীতে মেলোডির প্রাধান্য খুব বেশিমাত্রায়। সংগীতে মেলডির যে রূপ তিনি সৃষ্টি করেছিলেন, রসিকজন তাকে glorious music আখ্যায় ভূষিত করেছেন। এটাই তাঁর সংগীতের প্রকৃত পরিচয়। এমন নাট্যগুণান্বিত ও কাব্যসুষমা মণ্ডিত সংগীত তাঁর আগে সত্যিই বিরল ছিল। মোৎসার্টের কম্পোজিশনের সবথেকে বড় বৈশিষ্ট্য হল আনন্দ, বিষাদ, প্রেম বিরহ প্রভৃতি বিভিন্ন মানবিক অনুভূতির তরঙ্গোচ্ছল সঙ্গীত-সমুদ্রের মধ্যে বিরাজ করে এক অতি দরদী স্রষ্টার অসামান্য মানবিক আবেদন। এই বিরল গুণটিই তাঁর সংগীতকে চরম মহত্ত্ব দিয়েছে, যা পরবর্তীকালে বেটোফেনের মধ্যে আরও পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়।

সাহিত্য, কলা ও অন্যান্য শৈল্পিক ক্ষেত্রগুলির অনেকগুলি আধার আছে, যাকে ইংরেজীতে বা ফরাসিতে বলা হয় genre। ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীতে যেমন আছে ধ্রুপদ, খেয়াল, ঠুংরী, ভজন ইত্যাদি; ঠিক তেমনই ইউরোপীয় সংগীতে আছে সিম্ফনি (অর্কেস্ট্রায় যার পূর্ণাঙ্গ রূপ), সোনাটা (সাধারণতঃ একক, পিয়ানো বা ভায়োলিন), কনচের্তো (অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গ অর্কেস্ট্রা ও কোনও একক বা দুই বাদ্যের মধ্যে “যুগলবন্দী”), অপেরা (গীতিনাট্য), স্যুইট (অনেকগুলি ছোট ছোট রচনার একত্র সমাহার, সাধারণত নৃত্যের ছন্দে), ম্যাস, রেক্যুয়েম (ধর্মসঙ্গীত), চেম্বার মিউজিক (অর্থাৎ দুই, তিন, চার, পাঁচ থেকে ন’টি বাদ্যের একত্র সমাহার) ইত্যাদি। পাশ্চাত্যের সংগীত-স্রষ্টারা (composer) এর মধ্যে কোনও একটি বিশেষ genre নির্বাচন করে বিভিন্ন ধরনের সংগীত সৃষ্টি করেন। মোৎসার্ট সর্বপ্রকার আধারেই তাঁর সংগীত সৃষ্টি করেছিলেন যা স্বরলিপিতে (score) সযত্নে ধরা রয়েছে এবং অদ্যাবধি বিভিন্ন সংগীত মঞ্চে সেই অনুযায়ী পরিবেশিত হচ্ছে।

ক্লাসিক্যাল ইউরোপীয় তথা পাশ্চাত্য সংগীত সম্পূর্ণভাবে কম্পোজিশন-ধর্মী। তত্ত্বগতভাবে ক্ল্যাসিক্যাল বলতে সংগীতের ইতিহাসের একটা যুগ বোঝায়। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে ক্ল্যাসিক্যাল বলতে বোঝায় কম্পোজিশন-ধর্মী সঙ্গীত। সাহিত্যের গল্প, উপন্যাস, নাটক প্রভৃতি বিভিন্ন ধারার রচনার মতই পাশ্চাত্য সঙ্গীতের ক্ষেত্রে সিম্ফনি, সোনাটা, অপেরা প্রভৃতি হল বিভিন্ন ধারার রচনা। একটি বৃহদায়তন রচনায় দিনের পর দিন সময় লেগে যায়। ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীতের আসরে যেমন প্রশ্ন ওঠে কোন রাগ পরিবেশিত হবে, পাশ্চাত্য সংগীতের আসরে প্রশ্ন ওঠে কোন কম্পোজারের রচিত সংগীত অনুষ্ঠিত হবে।

মোৎসার্ট স্বল্পায়ু জীবনে রচনা করেছেন ৪১টি সিম্ফনি (মতান্তরে ৩৬ কি ৩১), ২১টি পিয়ানো কনচের্তো (পূর্ণ অর্কেস্ট্রা ও একক পিয়ানোর যুগলবন্দী), আটটি প্রধান অপেরা (গীতিনাট্য, যেখানে কন্ঠসংগীতের সঙ্গে কম্পোজার রচিত কৃত অর্কেষ্টা-যন্ত্রসংগীতেরও বহুল ব্যবহার থাকে)। তিনি পিয়ানো কনচের্তো ছাড়াও ভায়োলিন কনচের্তো, ক্লারিনেট কনচের্তো, ফ্লুট ও হার্প কনচের্তো এবং চারটি হর্ন কনচের্তো রচনা করেছেন। তা ছাড়া ঘরোয়া চেম্বার মিউজিকের মধ্যে আছে ২৪টি কোয়ার্টেট (অর্থাৎ চার বাদ্যের সমাহার), ক্যুইনটেট (quintet) (পাঁচ বাদ্যের সমাহার) এবং কোয়ার্টেটের সঙ্গে আরেকটি বাদ্যের যোগে রচিত সঙ্গীত ইত্যাদি। তার রচিত ধর্মসংগীতের মধ্যে আছে ম্যাস (mass) অরেটোরিও (oratorio) এবং রেক্যুয়েম (requiem) ইত্যাদি, সেগুলি সংখ্যায় প্রায় আট। কারও মৃত্যুর পর চার্চে তার আত্মার শান্তি ও সদগতি কামনায় রচিত হয় রেক্যুয়েম, অনেকের মতে যা হল মৃত্যুর সঙ্গীত। মোৎসার্ট তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে নিজের জন্য রেক্যুয়েম রচনা করেছিলেন, যেমন লিখেছিলেন ফেলিক্স মেণ্ডেসলন। অবশ্য এটি তাঁর নিজের সমাধিফলকের জন্য ‘এপিটাফ রেক্যুয়েম’ নয়। মোৎসার্ট তাঁর রেক্যুয়েম সমাপ্ত করতে পারেননি। তাঁর নির্দেশমত শিষ্য স্যুসমায়ার এটি সম্পূর্ণ করেছিলেন। তাঁর ছোট আয়তনের কম্পোজিশনের মধ্যে আছে অনেকগুলি সেরেনেড (serened হল প্রেম-সংগীত), ওভারচিওর (overture হল মূল কাব্যের উপক্রমণিকা স্বরূপ প্রারম্ভ-সংগীত) ডাইভার্টিমেন্টো, মার্চ ইত্যাদি। তবে তাঁর রচনাবলীর মধ্যে সব থেকে ওপরে স্থান পাবে অপেরাগুলি। তাঁর ম্যাজিক ফ্লুট, ডন জিওভানি, ম্যারেজ অফ ফিগারো ইত্যাদি রচনাগুলি নিঃসন্দেহে কালজয়ী কীর্তি। তারপর আসবে তাঁর সিম্ফনি ও কনচের্তো। বস্তুত তাঁরই হাতেই কনচের্তো পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। সাধারণভাবে তাঁর অপেরা, সিম্ফনি ও কনচের্তোগুলি গভীর নাটকীয় আবেগে ভরা।

ভারতে শাস্ত্রীয় সংগীতের বৈচিত্র্য অসীম এবং ব্যাপ্তি সাগরের মতো। এই সংগীতের রচনাশৈলী কোনও একটি বিশেষ ঘরানার সংগীতজ্ঞদের মধ্যে আবদ্ধ থাকে। সাধারণতঃ একটি ঘরানার বৈশিষ্ট্যযুক্ত সঙ্গীত (যাকে বন্দিশ বা চীড় বলা হয়) অন্য ঘরানার শিল্পীরা পরিবেশন করেন না। তা ছাড়া শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ক্ষেত্রে স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী এবং আভোগ নিয়ে গঠিত রচনার আয়তনও খুব দীর্ঘ নয়। তার মধ্যে রাগরূপ প্রতিষ্ঠা করাই প্রধান লক্ষ্য থাকে। এই পরিসরের মধ্যেই শিল্পীরা সীমাহীন বিস্তারের সুযোগ পান। সুতরাং কম্পোজিশন-ধর্মী পাশ্চাত্য ক্লাসিকাল সংগীত এবং ভারতীয় বিস্তারধর্মী রাগ-সংগীতের মধ্যে কোনও মিল নেই। তাই সম্পুর্ন ভিন্ন রূপের দুই সংগীতকলার মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা প্রায় নিরর্থক বলা চলে। তাহলে মোৎসার্ট ও রবিশংকরের মধ্যে  আমরা তুলনা করব কীভাবে?

রবিশংকর বেশ কয়েকটি নতুন রাগ সৃষ্টি করে ভারতীয় সংগীতকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁর সৃষ্ট বৈরাগী, তিলক-শ্যাম, ইমন-মাঁজ, মহাত্মা গান্ধীর স্মরণে মোহনকোষ ইত্যাদি রাগগুলি সংগীত-রসিকদের কাছে সমাদৃত হয়েছে। তাঁর ঈশ্বরী পর্যায়ের রাগগুলি – যেমন কামেশ্বরী, গঙ্গেশ্বরী, রঙ্গেশ্বরী এবং পরমেশ্বরী অসাধারণ সৃষ্টি। তিনি নটভৈরব রাগকে এক নতুন রূপ দিয়েছেন। এছাড়া অনেক সিনেমার প্রারম্ভ ও আবহ সংগীত রচনা তাঁর স্মরণীয় কীর্তি। তাঁর সুরারোপিত সত্যজিৎ রায়ের অপু-ট্রিলজির সংগীত বিশ্ববিখ্যাত, বিশেষত ‘পথের পাঁচালী’-র মূল ভাব অবলম্বনে সৃষ্ট সুর মন ছুঁয়ে যায়। হিন্দী সিনেমাতেও অনুরাধা, গোদান, মীরা, নীচা নগর প্রভৃতি চলচ্চিত্রের সংগীত রসোত্তীর্ন হয়েছে। জয়দেবের পদগুলিতেও তাঁর সুরসংযোগ মর্মস্পর্শী। মস্কোর ক্রেমলিনে অনুষ্ঠিত “বহুরঙ্গী” সব দিক থেকেই অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়। বিশেষত অনুষ্ঠানের ‘প্রারম্ভ-সংগীত’ ও ফিলিপ গ্লাসের সঙ্গে পরিবেশিত ‘শান্তিমন্ত্র’ প্রায় মোৎসার্টের সংগীতের মতনই হৃদয়স্পর্শী। ফিলিপ গ্লাসের সঙ্গে কাজগুলির পাশাপাশি তাঁর ‘Chants of India’-ও এক অপূর্ব কাজ।

রবিশংকর অনেক বিদেশি সংগীতজ্ঞের সঙ্গেই কাজ করেছেন, কিন্তু তাঁর সংগীতে কোথাও ইউরোপীয় ধারার অনুকরণ নেই। ভারতীয় সংগীতে এ ধরনের কাজ অশ্রুতপূর্ব, তবে তা যতই পরীক্ষামূলক হোক না কেন কোনওভাবেই ভারতীয় ভাবসৌন্দর্য হারায়নি। বিভিন্ন নৃত্যনাট্যের সংগীতের মধ্যেও তাঁর সৃজনী প্রতিভার স্বাক্ষর আছে। জুবিন মেহতার সঙ্গে অনুষ্ঠিত ‘সেতার/রাগমালা কনচের্তো’, রিচার্ড অ্যাটেনবরোর ‘গান্ধী’ চলচ্চিত্রের আবহ-সংগীত এবং ‘Asiad 32’-র সংগীতও রসোত্তীর্ণ হয়েছে। ‘গান্ধী’-র আবহ সংগীতের জন্য তিনি অস্কার পেয়েছিলেন। এছাড়াও রবিশংকরের এমন অনেক রচনা আছে যা শোনার সৌভাগ্য থেকে সংগীতপ্রিয় মানুষ বঞ্চিত। যেমন রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে তাঁর ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’-র সঙ্গীতরূপ সাধারণ শ্রোতার কাছে পৌঁছাতে পারেনি। আকাশবাণী বাদ্য-বৃন্দের জন্যও তাঁর অনেক সুন্দর কম্পোজিশন আছে, যা সাধারণের মধ্যে সেভাবে প্রচারিত হয়নি।

রবিশংকরের সংগীতের ভাবসম্পদের গভীরতার দিক থেকে চিন্তা করলে তাঁর সৃষ্ট রাগের কথাই প্রথমে মনে হবে। রাগসংগীতের বাইরে রবিশংকরের অন্যান্য রচনাগুলি রসোত্তীর্ণ হলেও তা মোটের উপর পরীক্ষামূলক বলা চলে। কিন্তু মোৎসার্টের সংগীতের সঙ্গে তুলনামূলক বিচারে তা হয়ত পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য হবে না, কারণ ভারতীয় ও পাশ্চাত্য সংগীত-পদ্ধতির মধ্যে পার্থক্য একেবারে মূলগত। পাশ্চাত্যের সংগীত-রচনার একটা বড় ঐতিহ্য রয়েছে যা মোৎসার্টের সংগীতকে পুষ্ট করেছে। তারই মতো প্রাচীন সংগীত-ঐতিহ্য হিন্দুস্তানী সংগীতে যেমন আছে, তেমনই কর্ণাটকী সংগীতেও আছে। ত্যাগরাজ, দিক্ষীতার, শ্যামশাস্ত্রী প্রভৃতি নাম শ্রদ্ধার স্মরণীয়। হিন্দুস্তানী তথা উত্তর ভারতীয় সঙ্গীতে কম্পোজারের থেকে শিল্পীর প্রাধান্য বেশি। সেখানে এক একটি বন্দিশ বা গত-কে আশ্রয় করে শিল্পী তাঁর বিস্তারের ক্ষমতা প্রদর্শন করেন।

রবিশংকর এমন একজন শিল্পী, যিনি ভারতীয় সংগীতের মর্মবাণী সমগ্র বিশ্ববাসীর হৃদয়ে পৌঁছে দিতে পেরেছেন। একইভাবে মোৎসার্টও তাঁর অমর রচনাগুলির মাধ্যমে পৃথিবীর সব প্রান্তের শ্রোতার হৃদয় ছুঁয়েছেন। পাশ্চাত্য সঙ্গীতে লিখিত স্বরলিপির চর্চা বরাবরই ব্যাপকভাবে প্রচলিত, কিন্তু ভারতীয় সঙ্গীতে ততটা নয়। তাই রেকর্ড আবিষ্কারের আগেই লিখিত স্বরলিপির মধ্যে দিয়ে মানুষ মোৎসার্টকে চিনেছে। কিন্তু রবিশংকরকে চিনতে হলে উত্তরপ্রজন্মকে তাঁর রেকর্ডের নির্ভর করতে হবে। তাঁর রেকর্ডগুলি মন দিয়ে শুনলে সঙ্গীতের নতুন দিগ্‌দর্শন, কাব্যসুষমা ও নাটকীয় গভীরতার সম্যক উপলব্ধি হবে।

সব দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায় রবিশংকর ও মোৎসার্টের তুলনামূলক বিচার অত্যন্ত কঠিন এবং কিছুটা নিরর্থকও বটে। কারণ উভয়ের সঙ্গীতসৃষ্টির লক্ষ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাই তাঁদের দুজনকে পৃথক দৃষ্টিতে দেখাই ভাল। তাঁরা স্বক্ষেত্রে অনন্য এবং নিজ নিজ জগতে স্বমহিমায় ভাস্বর। আসলে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রের দিকপালদের সঙ্গে তুলনা করাটা যেন একটা অভ্যাসের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতএব বঙ্কিমচন্দ্রকে বাংলার ওয়াল্টার স্কট, গিরীশচন্দ্র ঘোষকে বাংলার গ্যারিক ইত্যাদি না বললে যেন তৃপ্তি আসে না। অবশ্য এটা খুবই স্বাভাবিক যে কোনও ব্যক্তি যখন উৎকর্ষের শীর্ষে পৌঁছে যান তখন তাঁর সঙ্গে তুলনামূলক বিচার করে পরবর্তীকালের শিল্পীদের মূল্যায়ন করা হয়। যেমন বেটোফেনকে বলা হয় সঙ্গীতের শেক্সপিয়র। রবিশংকরকে আজকের মোৎসার্ট বলা অবশ্যই অত্যন্ত সম্মানসূচক। পাশাপাশি এটাও ঠিক যে মোৎসার্ট পৃথিবীতে আবির্ভূত না হলেও রবিশংকরের গৌরব কিছুমাত্র ক্ষুণ্ণ হত না, এবং এ কথা বিপরীতক্রমেও সত্য। আসলে সঙ্গীত-জগতের দিকপালদের শৈল্পিক মহত্ত্ব বুঝতে তাঁদের সঙ্গে সমতুল্য আর কাউকে টেনে আনার প্রয়োজন হয় না। সংগীত রসিকদের হৃদয়ে তাঁদের জন্য চিরস্থায়ী আসন পাতা আছে।

 

  ……0……

Leave a comment

Check Also

গোল করলেন বাঘুবাবু

বাঘু দিল গো-ও- ও-ল – মৌসুমী পাত্র

  শীতটা এবারে কেমন যেন ল্যাজ গুটিয়ে পালিয়েছে! অন্যান্য বছর কার্তিক মাস পেরোতে না পেরোতেই …

আশমানি পাঠশালা

আশমানি পাঠশালা – ইন্দ্রানী ভট্টাচার্য্য

  ” ডান দিকটা একটু ওপরে উঠে গেছে। নামা। ব্যস, ঠিক আছে। এবার দড়িটা শক্ত …

আত্মারামের বাসর যাপন

আত্মারামের বাসর যাপন – রঘুনাথ মণ্ডল

    আত্মারামের বিয়ে, কনে বিল্ববাসিনী। আগে আত্মারাম কনে দেখেনি। বাবা, মামা সম্বন্ধ করে ঠিক …

সেই সব শীতকাতুরেরা

সেই সব শীতকাতুরেরা – সোমক সেনগুপ্ত

[ সে এক সময় ছিল বটে! ভিনগ্রহী জীব তবু হয়তো কল্পনা করা যেত- কিন্তু মোবাইল …