Home / গল্প / নিঃশব্দে নাও নিশ্বাস- নীলম আহমেদ বশীর (ভাষান্তর ও বাংলায়ন: বদরুদ্দোজা হারুন)

নিঃশব্দে নাও নিশ্বাস- নীলম আহমেদ বশীর (ভাষান্তর ও বাংলায়ন: বদরুদ্দোজা হারুন)

নিঃশব্দে নাও নিঃশ্বাস
শিল্পী- পুণ্যতোয়া

 

[পবিত্র ধর্মগ্রন্থের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার মতো একটি কুপ্রথা পাকিস্তানের সিন্ধুপ্রদেশের গ্রাম্য অঞ্চলে আজও প্রচলিত। ধর্মের নামে নারীত্বের এই চূড়ান্ত অপমানে বিচলিত পাকিস্তানের বিশিষ্ট  সাংবাদিকসাহিত্যিক  নীলম আহমেদ বশীর তাঁর কলমকেই বেছে নিয়েছেন প্রতিবাদের অস্ত্র হিসেবে। অমানবিক একটি কুসংস্কারকে ধর্মীয় মোড়কে উপস্থাপন করলে ব্যক্তিজীবনে তার কুফল কতটা মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে লেখিকার শাণিত লেখনশৈলীতে তার মর্মন্তুদ বিবরণ আমাদের শিহরিত করে। সমাজসচেতন বিশিষ্ট লেখক বদরুদ্দোজা হারুন বিষয়জনিত বৈচিত্রের কারণে বাংলাভাষী মানুষদের জন্য ভাষান্তরিত করে বলতে চেয়েছেন সত্য কখনো কখনো কল্পনাকেও হার মানায়।]

 

“আপনার বেটির শাহী শাদী মোবারকে আমার দিল-উপচানো অভিনন্দন গ্রহণ করুন সাইন সা’বা।”

“শুকরিয়া। বহুত বহুত শুকরিয়া। আপনাকেও আমার শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা। নূরবানু তো আপনার বেটির মতোই। আপনার মেয়ে সখিনা ও নূরবানু ছোটবেলা থেকেই একে অপরের প্রিয় সখী ও খেলার সাথী। ওদের শৈশবের উজ্জ্বল ও উচ্ছ্বাসের দিনগুলি আজও আমার দিলকে স্পর্শ করে, আব্দুল করিম!” কথাগুলো একনাগাড়ে বলে সাইন ওয়াদি   আদরের হাত রাখলেন তাঁর পিঠে। আব্দুল করিম নিজেকে খুব খুশনসিব বলে মনে করলেন।

সাইন সাহেব এবার বেশ কিছু টাকা করিম সাহেবের হাতে গুঁজে দিয়ে মৃদু হেসে বললেন, “সখিনা বেটির শাদীতে আমার এই নগন্য তোওফা হয়তো তারিফযোগ্য নয়, তবুও আপনার কিছুটা প্রয়োজন মেটাতে পারলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করবো।”

করিম সাহেব নিজেকে খুবই কৃতজ্ঞ বোধ করলেন। অজান্তেই তাঁর দু’চোখ দিয়ে দু’ফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়লো, তিনি তৎক্ষণাৎ নিচু হয়ে গ্রামের সবচেয়ে উঁচুদরের রইস আদমি ওয়াদি সাইনের পায়ে মাথা ঠেকিয়ে কদমবুসি করতে চাইলেন।

“উঠুন ,উঠুন। মেহেরবানী করে আমাকে গোনাহগার করবেন না করিম ভাই। সিজদা নেওয়ার মালিক একমাত্র দিনদুনিয়ার বাদশাহ আল্লাহতবারকতায়ালা। তাঁরই কাছে মোনাজাত করুন যাতে আমাদের উভয়ের নয়নের মণি কন্যারত্ন দু’টি অপার সুখ সাগরে ভাসে এবং তাদের নতুন জীবন সবদিক থেকে আনন্দময় হয়ে উঠে।”

 

নূরবানু বারবার আরশির সামনে নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলো। বহুমূল্য মণিমুক্তাখচিত শাদীর সজ্জায় সত্যিই তাকে বেহেস্তের হুরীর মতো অনিন্দ্যসুন্দরী লাগছিলো। তার ঘনকৃষ্ণ আঁখিপল্লবে যেন ময়ূরের পেখমখোলা নৃত্য, গোলাপি ঠোঁট দু’টি কামনায় রঞ্জিত, কোন প্রিয়-পুরুষের চুম্বনপ্রত্যাশায় উদ্বেলিত! তার  থরথর তনু  যেন শরম-সৌরভে সিক্ত। তার কানপাশার ঔজ্জ্বল্যে যেন স্বয়ং শামসও আজ লজ্জায় অবনত।

ঠিক বাদশাহজাদির মতোই লাগছে তাকে। অনুপম সৌন্দর্যে, দেহসৌষ্ঠবে, সুবাসিত সৌরভে সে যেন এই মুহূর্তে আকাশপরী। তাকে সেখান থেকে নামিয়ে বলিষ্ঠ বাহুদ্বয়ে বুকে জড়িয়ে চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে দেবে যে  শাহেনশাহ, সে এখন কত দূরে!..

নিজের মনেই হেসে উঠলো নূরবানু। সে কি সত্যিই এতো সুন্দরী! না, স্বপ্ন দেখছে…! অথবা সবটাই তার মনের খেয়াল!…আঃ খোদা! নূরবানু পারে না আর নিজেকে ধরে রাখতে।….  সে দরজার দিকে ছুটে গেলো। উঁকি দিয়ে দেখলো কেউ কি তাকে দেখছে! না, কেউ নেই। তবে শব্দ শোনা গেলো। মিরাজওয়ালিদের গীতের শব্দ।

অর্থাৎ তারা এসেছে। শীঘ্রই তারা নামবে নাচের  আসরে। তাদের গুনগুন গলা-সাধার আওয়াজ ভেসে আসছে। সেইসঙ্গে রুনুঝনু নুপুরের ছন্দ। আকাশে-বাতাসে, আভাসে-ইঙ্গিতে ধ্বনিত হচ্ছে ….আসছে–আসছে… মিলনের সেই মহালগ্ন আসছে মেঘের হাওয়ায় সওয়ার হয়ে। শিগগিরিই তার দরজায় করাঘাত হবে।…

কিছুক্ষণ পরেই হাভেলিতে হৈহুল্লোড় ও আনন্দের ফোয়ারা যেন ঝর্না হয়ে ঝরঝর করে ঝরে পড়তে লাগলো। মিরাজওয়ালিদের গানের উদ্দামতা আর সুরের মাদকতার মধ্যে নারীপুরুষের মিলনের ব্যাকুলতা গোটা এলাকাকেই মাতোয়ারা করে তুললো। আর তাদের সঙ্গে ঢোল ও বাদ্যযন্ত্রে নিয়ে পুরুষরা সমানতালে সঙ্গত দিতে লাগলো। এমনকি সুরের জাদুতে আকৃষ্ট হয়ে, কিছুক্ষণ পরেই পরিবারের পুরুষ সদস্যদের সাথে স্বযং ওয়াদি সাইন এবং তাঁর পুত্রদেরও ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা গেলো। এসব তাদের পারিবারিক ও বংশীয় রীতি। গীতবাদ্যের তালে তালে নাচনেওয়ালি মহিলা বা তাবায়েফদের সাথে অঙ্গ দুলিয়ে নৃত্য করা বংশীয় আভিজাত্যও বটে।

জানলা থেকে চিকের ফাঁক দিয়ে নূরবানু ঈষৎ লজ্জায় রাঙা হয়ে সেই অনিন্দ্য দৃশ্য উপভোগ করতে লাগলো। এসব যে তাকেই কেন্দ্র করে ভাবতে গিয়ে তার সর্বশরীরে অজানা শিহরণের তরঙ্গ যেন আছড়ে পড়তে লাগলো। কিন্তু একটা বিষয়ে সে আশ্চর্য হয়ে গেলো যে, পরিবারের বা প্রতিবেশী মেয়েদের মধ্যে যেন কোন উচ্ছ্বাসই নেই! সবাই দমদেওয়া কলের পুতুলের মতো যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে! তারা সবকিছু দেখছে শুনছে, কিন্তু সবাই যেন রাতের বাসী গোলাপ বা বাসর রাতের প্রদীপ, সারা রাত জ্বলে জ্বলে এখন জৌলুসহীন, ম্লান।

এমন কেন, এমন কেন হচ্ছে ব্যাপারগুলো? নিঃশব্দে প্রশ্ন উঠে গেলো নূরবানুর মনে। একটা অজানা আশংকার কালো ছায়া আচমকাই যেন ধেয়ে আসলো তার ঘরের চৌকাঠ অবধি। সে বিস্ময়ের সঙ্গে আরো দেখলো হাভেলিতে তার যত প্রিয় সহচরী আছে, তাদের একজনও উপস্থিত নেই আজকের নাচের আসরে। যারা আশেপাশে রয়েছে, তাদেরও দেখে মনে হচ্ছে তারাও সব যেন ওই দমদেওয়া কলের পুতুল। দম দিলে চলবে, দম ফুরুলে ধপ করে পড়ে যাবে।

যাকে বলে প্রাণখোলা হাসি, তা আজ কোন মেয়ের মুখেই নেই। তবে আরো একটি বিস্ময়কর ব্যাপার,আম্মা, ফুপি-আম্মা,খালা-আম্মা, এমনকি বাড়ির কাজের মেয়েরাও পর্যন্ত তাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে। “কী ব্যাপার? নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করে নূরবানু, “আমার স্বামী কি খুবই বৃদ্ধ কিম্বা এতই কুৎসিত যে, তাকে দেখে সবাই মনমরা হয়ে গিয়েছে?” ভাবতে গিয়ে তার উচ্ছল আনন্দ হঠাৎ কোন বিষণ্ণ মেঘে ঢেকে গেলো। তবুও তার স্থায়িত্ব বেশিক্ষণ থাকলো না, “না, এসব হতে পারে না। সবই আমার ভুল ভাবনা। এতো রূপ আমার, আমার বর কি কখনো কুৎসিত হতে পারে?  না,এ অসম্ভব। নিশ্চয়ই সে রূপেগুণে, শরীরস্বাস্থ্যে,আমার উপযুক্ত স্বামী হবার সব যোগ্যতাই রাখে, আমি শুধু অহেতুক চিন্তায় নিজেকে ভারাক্রান্ত করছি”–নিজেকে নিজেই সান্ত্বনা দেয় নূরবানু।

সে আরশিতে ঘুরেফিরে আবার নিজেকে দেখে। এ রূপের জোয়ার আর বাঁধভাঙা যৌবন-উচ্ছ্বাস যেন প্রিয়তমের প্রতীক্ষায় ক্রমশঃ মদির ও লাস্যময় হয়ে উঠছে। “আঃ খোদা! এতো সৌন্দর্য আমায় দিয়েছো কেন? তুমি কি সত্যিই আমাকে এতই ভালোবাসো?”–রোমাঞ্চিত তনু থরথর করে কেঁপে উঠে নূরবানুর।

আধভেজা দরজা দিয়ে হঠাৎ তার চোখ পড়ে রেলিংঘেরা সুবিশাল বারান্দার দিকে। সে দেখে তার আব্বা আর দুই ভাই এগিয়ে আসছে তার ঘরের দিকে। সে তাড়াতাড়ি পালঙ্কে উঠে জড়োসড়ো হয়ে বসে পড়ে। জরির ঘোমটায় মুখ ঢাকে লাজে। “ওরা আসছে কেন? তাকে তাড়াতাড়ি বিয়ের জন্য তৈরি হওয়ার কথা বলতে, না অন্য কোন সংবাদ শুনাতে যা তার জন্য মোটেই শুভ নয়। হয়তো বা! নইলে তো এসব ব্যাপরে আম্মি বা বাড়ির অন্য কোন আত্মীয়াদেরই আসার কথা!”–অজান্তে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে নূরবানুর অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে।

 

দুই

 

ওরা এলো। বধূবেশে নূরবানুকে একবার দেখলো শুধু। তারপর ঘরের চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে চলে গেলো। নূরবানুর কেমন যেন সন্দেহ হলো। তবে কি তার আশংকাই  সত্যে পরিণত হতে চলেছে? “না,তা কেন? ওরা পুরুষ মানুষ। ওরা আর কী বলবে? যা বলার আম্মি বা খালা-আম্মিরাই বলবে। সে অনর্থক অমঙ্গল আশংকা করছে”–নূরবানু আবারও নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলো।

নূরবানুর অলৌকিক রূপ, কস্তুরী-আতর  এবং বসরাই গোলাপের সৌগন্ধকে ছাড়িয়ে যাওয়া দেহজ ঘ্রাণ, গোটা ঘরটাকে যেন মোহময় করে তুলেছে। বাইরে থেকে যে কেউ আসুক, বেশিক্ষণ তার পক্ষে সেখানে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। নূরবানুও তা টের পাচ্ছে। আদিম আনন্দের সব উপকরণই তাঁর দেহে ঢেলে দিয়েছে বিধাতা।  কামনামদির দিলে এখন সে শুধু তার প্রিয়তমের প্রতীক্ষায়…

অথচ সবকিছুর মধ্যেই একটা ছন্দ পতন, এক অশরীরী আত্মার দীঘল কালো ছায়া দেখছে সে। তার মনে হচ্ছে সে যেন এখন  স্থাণুবৎ পুতুলপ্রায় একটি মূর্তিমাত্র, সব অনুভূতিই আছে, প্রকাশভঙ্গি নেই। কারণ কিছুক্ষণ আগে আম্মা কয়েকজন আত্মীয়াপরিজনদের  নিয়ে তার ঘরে এসেছিলেন। একবার শুধু চারিদিকে চেয়ে দেখেছেন, তারপর নিঃশব্দে চলে গিয়েছেন শুধু একটা লম্বা শ্বাস ফেলে, যা এখনো ঘরের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে শূন্য হাহাকারের মতো।

বাইরে শামিয়ানা টাঙিয়ে বিশাল প্যান্ডেল তৈরি করা হয়েছে। দলে দলে লোকজন আসছে, কোর্মা-পোলাও-তন্দুরি, হরেক মিষ্টান্ন, অঢেল ফল, মধুর চেয়েও মধুর শীতল পানীয় –তৃপ্তি করে খাচ্ছে, ঢেঁকুর তুলছে, আর তার বাপজান ওয়াদি সাইনকে খোশ-আমেদ জানিয়ে চলে যাচ্ছে।

এসবই তো জবরদস্ত শাহি খানদানির শাদীর সাবুদ। তবে দুলহা কৈ? নিকাহনামার জন্য মৌলভি,উকিল ও সাক্ষী কৈ?

আস্তে আস্তে সবই ভেল্কিবাজির মতো উবে গেলো। একসময় গোটা বাড়ি ফাঁকা হতে লাগলো। শাদীর সানাই কোন দূর প্রান্তরে হয়তো  গুমরিয়ে  কাঁদছে এখনও। ক্রমে তুমুল নৈঃশব্দ্য হাভেলিতে নেমে এলো শান্তির ঘোমটা টেনে। ঘরে এখন নূরবানু শুধু একা। কিম্বা এ হয়তো নূরবানুই নয়, নূরবানুর মতো অবিকল অন্য কোন নারী,যে বিস্ময়-বিহ্বল নূরবানুর দিকে ব্যঙ্গের আঙ্গুল তুলে মিটিমিটি হাসছে।

হঠাৎ নূরবানুর মনে হলো তার কলিজার ভিতর কে যেন একটা বিষাক্ত তরবারি আমূল বিদ্ধ করে এফোঁড় ওফোঁড় করছে। তীব্র বেদনায় অস্ফুট গোঙানির মতো শোনালো তার কণ্ঠ, “আমার স্বামী, আমার প্রিয়তম, কোথায় তুমি?” দ্রুত পায়ে সে বাসরশয্যার  ওপাশটা স্পর্শ করে দেখলো। না,কেউ কোথাও নেই। শূন্য।… একদম শূন্য। বিলকুল ফাঁকা।..

সেই নিশ্ছিদ্র শূন্যতার দিকে চেয়ে এক গভীর দীর্ঘশ্বাস তার বুকের ভিতরটা কাঁপিয়ে বেরিয়ে এলো। আর তখনই সে দেখতে পেলো এক অনিন্দ্যকান্তি ছায়াপুরুষ তার দিকে চেয়ে আছেন। নূরবানু এবার তার সব শূন্যতাকে ঝেড়ে ফেলে তার দিকে এগিয়ে গেলো, তার চারপাশে ঘুরলো। তারপরেই সে তার সামনে উজ্জ্বল সবুজ  যুপদানিতে আবৃত  সেই সর্বোত্তম প্রেমিকসত্তার আহ্বানে সাড়া দিলো, যিনি  তার স্বামী, যাঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ আগেই তার শাদী হয়েছে। সে আল্লাহর বাণীসম্বলিত সেই পবিত্র মহাগ্রন্থটিকে আবেগদীপ্ত হয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলো, চোখ বন্ধ করে অস্ফুটে উচ্চারণ করলো, “আমার স্বামী, আমার হৃদয়ের অধিপতি, আমার প্রিয়তম।”

তারপর সে পালঙ্কের ওপরে উঠে বসলো, যুবদানির ফিতেগুলি আলগোছে খুললো এবং উচ্চকিত কন্ঠে আল্লাহর পাক কালাম পড়তে লাগলো, “পাঠ করো করো সেই পরম প্রভুর নামে…”। সে পড়তেই থাকলো, তার কন্ঠস্বর উচ্চ থেকে উচ্চতর হতে লাগলো, ক্রমে তা এতো উঁচু পর্দায় উঠে গেলো যে, আকাশ প্রকম্পিত করে সে আওয়াজ হাভেলির অলিগলি, জানলা-দরওয়াজা, এমনকি ঘুলঘুলি, বারান্দা এবং চত্বর–সর্বত্রই পৌঁছে গেলো। নূরবানুর আম্মির ঘরেও  পৌঁছে গেলো সে আওয়াজ।

আম্মি আর স্থির থাকতে পারলেন না, তাঁর কলজে পুড়ে যেন খাক হতে লাগলো। নীরবে ঘন ঘন শ্বাস টেনে বুকের দুঃসহ যন্ত্রণাকে তিনি সহ্য করার চেষ্টা করতে লাগলেন। তাঁর দুই চোখের কোণ বেয়ে দুর্বার অশ্রু কিছুতেই বাঁধ মানতে চাইলো না।

না, কিছুতেই ঘুম এলো না। আম্মি শত চেষ্টা করেও দুই চোখের পাতাকে জুড়তে পারলেন না। যন্ত্রণায় শুধু ছটফট করতে লাগলেন। তাঁর এই অবস্থা শুরু হয়েছে সেদিনই, যেদিন থেকে তাঁর স্বামী এবং দুই পুত্র হতভাগিনী নূরবানুর তকদীরে শীলমোহর মেরে দিয়েছে।

আম্মি তাঁর কষ্টের কথা মুখ ফুটে কাউকে বলতে পারেননি, এমনকি নূরবানুকেও না। শুধু চোখের পানিতে বালিশ পর্যন্ত ভিজে গিয়েছে। ঘুম যেন তাঁর চোখের পাতা থেকে চিরকালের জন্য বিদায় নিয়েছে।

যে রাত হতে পারতো নূরবানুর সোহাগ রাত, তার হৃদয়ের সমস্ত আবেগ দিয়ে তিল তিল করে গড়া এক কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নপুরুষের প্রথম স্পর্শের লাজ ভাঙার রাত, সে রাতে সে নিবিড় আবেগে পবিত্র গ্রন্থ তেলোয়াতের নামে যেন এক আহত বাঘিনীর মতো শুধু গর্জনই করে চলেছে। তার আম্মিই শুধু শুনতে পাচ্ছেন সেই গর্জনের মাঝে কন্যার কান্নাভেজা কন্ঠ।

শুনতে শুনতে একসময় ক্লান্ত, অবসন্ন হয়ে হঠাৎ যেন ঘুমের মধ্যে তলিয়ে গেলেন কোন অন্ধকার সাগরে। আর সেই অবসরে দুঃস্বপ্নরা একের পর এক থাবা বসাতে লাগলো তাঁর দিলে, রক্তাক্ত করে তুললো তাঁকে। তিনি পরিষ্কার দেখলেন, শাদীর সাজে নূরবানু তার সামনে এসে সলজ্জ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ডাকলো, “আম্মু”…,আর সঙ্গে সঙ্গে কোথা থেকে দমকা বাতাস এসে নূরবানুকে আকাশে উড়িয়ে নিয়ে গেলো, যেন একটা ঘূর্ণাবর্তে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেলো!..

তিনি কিছু দেখতে পেলেন না, এমনকি নূরবানুকেও না। হঠাৎ বিদ্যুতের চমকে ঝলসিয়ে উঠলো চারদিক,  আর নূরবানু সঙ্গে সঙ্গে এক অতিকায় বাদুড়ে রূপান্তরিত হয়ে গেলো। সে তাঁর ঘরের চারপাশে উড়তে লাগলো, পাষাণ দেওয়ালে তীব্র আক্রোশে ডানা ঝাপটাতে লাগলো, নিজের শরীরকে আছড়িয়ে আছড়িয়ে মারতে লাগলো পাষাণ দেওয়ালে,ক্ষতবিক্ষত করে তুললো সারা শরীর। আর তারপর নিজের শরীরের রক্তফোয়ারায় নিজেই নিজেকে ভাসাতে লাগলো।

হঠাৎ আম্মির ঘুম ভেঙে গেলো। শুনতে পেলন নূরবানুর মেঘগর্জন, সে এখনো পবিত্র গ্রন্থ পাঠ করে চলেছে, উচ্চ থেকে ক্রমশঃ উচ্চতর হচ্ছে তার কন্ঠস্বর। সে যেন ঠিক পাক কিতাব তেলোয়াত করছে না, আম্মির হৃদয়কে ধারালো ছুরি দিয়ে কেটে খানখান করছে। তিনি আর স্থির থাকতে পারলেন না। নিজের ঘর থেকে নিজের নির্জীব শরীরটাকে কোনক্রমে টেনেহিঁচড়ে বের করে নূরবানুর ঘরের দিকে আগাতে থাকলেন।

কিন্তু এ কি দেখছেন তিনি! নূরবানুর ঘরের বন্ধ দরজার  সামনে তাঁর জন্মদাতা পিতা  ওয়াদি সাইন  এবং তার দুই সহোদর ভাই দাঁড়িয়ে রয়েছে। গভীর আগ্রহে শুনছে নূরবানুর পবিত্র গ্রন্থ পাঠ, শুনছে তার অলৌকিক কন্ঠস্বর।

“কোথায় যাচ্ছো আম্মি”–শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে জ্যেষ্ঠ পুত্র তাঁকে জিজ্ঞাসা করলো।

“নূরবানু”–আর কিছু বলতে না পেরে শুধু আঙ্গুল দিয়ে কন্যার ঘর দেখালেন জননী।

“আম্মি”–বলে তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র তাঁর দিকে এগিয়ে এলো, “আম্মি, আপা এখন পাক কিতাব তেলোয়াত করছে। তাকে বেফজুল বিরক্ত করা একবারেই অনুচিত কাজ হবে এখন। আজ তো তার  অধিকার আছে এসব করার। তুমি তো জানো আম্মি, আমাদের আপামণি অসাধারণ একটি কাজ করেছে। সামান্য পার্থিব বিবাহবন্ধনের আকর্ষণকে সে জয় করতে পেরেছে, শাশ্বত সত্যগ্রন্থকে সে স্বামী বলে গ্রহণ করেছে। কতবড় বুলন্দ নসিব তার বলো তো আম্মি? আর তার সঙ্গে আমাদের গোটা পরিবারের মর্যাদাকে সে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে। সারা গ্রাম ধন্য ধন্য করছে তার নামে। তাহলে তুমি কেন এমনভাবে ভেঙে পড়ছো আম্মি?”

কনিষ্ঠ পুত্রের কথা শুনে আম্মি স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। এ কে, এমনভাবে কথা বলছে তাঁর সঙ্গে? এ কি তাঁরই গর্ভজাত সেই সন্তান যে তিল তিল করে তাঁর অস্থি, মজ্জা, রক্ত নিয়ে এই সুঠাম অবয়ব পেয়েছে! একে তো তিনি চেনেন  না!

“আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গেই থাকেন”–সাইন ওয়াদি কোমল কণ্ঠে স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিলেন। কিছুক্ষণ কারও মুখ দিয়ে আর কোন কথা বের হলো না। শুধু নূরবানুর ঘর থেকে এক অস্থির সমুদ্রের কুলপ্লাবী আওয়াজ সমস্ত নীরবতাকে যেন ভেঙে খানখান করে দিতে চাইছে। আম্মি কেঁপে উঠলেন। অসহায় বাদুড়টি তার ডানা ঝাপটাচ্ছে, পাষাণ দেওয়ালে মাথা ঠুকে ঠুকে রক্তাক্ত করে তুলছে  নিজেকে।

আম্মি আর সহ্য করতে পারলেন না। সহসা তাঁর মাথা ঘুরে গেলো। গোটা দুনিয়া যেন তাঁকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। তিনি অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন।  সাইন ওয়াদি ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে ইঙ্গিত করতেই দু’জন বাঁদী দ্রুত এগিয়ে এলো। তারা  ঠান্ডা পানি তাঁর চোখেমুখে ছিটিয়ে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করলো ,তারপর ধরাধরি করে তাঁর শোয়ার ঘরের দিকে তাঁকে নিয়ে গেলো।

কিছু পরেই সাইন ওয়াদি তাঁর ঘরে এলেন। পাশে বসে বোঝানোর ভঙ্গিতে বলে চললেন,  “এইরকম করার কোন অর্থ হয় না। আমাদের সমস্ত জমিজমা, ঘরবাড়ি,অর্থসম্পদ আমাদের দুই পুত্র পাবে এবং পরবর্তীতে উত্তরাধিকারসূত্রে তাদের ওয়ারিশগণের হাতেই সবকিছু থাকবে। এক কণাও বাইরে বেরিয়ে যাবে না। আর তার চেয়েও বড় কথা, তোমার নয়নের পুত্তুলি, প্রিয় কন্যা চিরকালই তোমার কাছেই থাকবে, একটি দিনের জন্যও কাছ ছাড়া হবে না। তার বিচ্ছেদ-অনল তোমাকে কোনদিনই সহ্য করতে হবে না। সত্যি করে বোলো তো, এতে কি তোমার আনন্দ হচ্ছে না?”-সাইন ওয়াদি তাঁর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বললেন।

কোন কথা নূরবানুর গর্ভধারিণীর কানে পৌছুলো কিনা ঠিক বুঝা গেলো না। কিন্তু তাঁর দুই নয়ন থেকে সজল ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো। জ্যৈষ্ঠ পুত্র এগিয়ে এসে পরম আদরে মায়ের চোখের পানি চাদরের খুঁট দিয়ে মুছে দিতে দিতে বললো, “আম্মি, এবার শুয়ে পড়ো, সারাদিন তোমার খুব ধকল গিয়েছে। আমাদের ভগ্নী তো সত্যিই অসাধ্য সাধন করেছে। তার এই কৃতিত্বকে ছোট করে দেখো না আম্মি। নিশ্চিন্তে তুমি  ঘুমিয়ে পড়ো এখন। কাল গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করবে। তাকে বুঝাবে। দেখবে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।”

স্বামী এবং পুত্রগণ ঘর ছেড়ে চলে যাওয়ার পরও একটুখানি যন্ত্রণার উপশম হলো না আম্মির। কিন্তু সে রাতে আর কিছুতেই নূরবানুর ঘরের দিকে পা বাড়াতে সাহসী হলেন না তিনি।  নিজের ঘরে বিছানায় বসে কন্যার উচ্চকিত কণ্ঠের কোরানশরীফ তেলোয়াত শুনতে লাগলেন। ভোর পর্যন্ত গমগম করতে লাগলো সে কন্ঠস্বর। তারপর হঠাৎ স্তব্দ হয়ে গেলো সবকিছু। কে যেন শ্রান্ত, ক্লান্ত, বিধ্বস্ত নূরবানুর চোখের উপর  ঘুমের পর্দা ফেলে দিলো একান্ত গোপনে।

সকালে যখন সূর্যের আলোয় চারিদিক ঝলমল করে উঠলো, আম্মি ধীর পায়ে নূরবানুর ঘরের ঠেসানো কপাট ঠেলে ভিতরে ঢুকলেন। দেখলেন নূরবানু তখনও পবিত্র গ্রন্থটিকে বুকে জড়িয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, তার পরনে ঝলমলে শাদীর সাজ। লাল চেলি, মণিমাণিক্যখচিত অলংকারের দ্যুতিময় দীপ্তি। তিনি কিছুক্ষণ চেয়ে চেয়ে দেখলেন কন্যার রূপের বন্যাকে। অজান্তে একটা গাঢ় দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো, আবারও অশ্রুসজল হয়ে উঠলো তাঁর দুই চোখ। ওড়নির প্রান্ত দিয়ে মুছলেন, ছিঁচকাঁদুনে মেয়ের মতো নাক টানতে লাগলেন ঘনঘন। “আমার হতভাগিনী বেটি, আমার হতভাগিনী বেটি”– বলতে বলতে বেরিয়ে এলেন কন্যার ঘর থেকে।

বেলা বাড়তে বাড়তে সূর্য এখন প্রায় মাথার উপরে। নূরবানু তখনো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আম্মি তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রী জয়নবকে পাঠালেন নূরবানুর ঘুম ভাঙাতে।

“ওঠো, ওঠো”– আমার পেয়ারের বোনটি,এবার উঠে পড়ো। প্রায় দুপুর হয়ে গেলো।” জয়নব নূরবানুর মাথায় হাত দিয়ে ঝাঁকুনি দিতে থাকলো।

“যা তো এখন ঘর থেকে, আমার এখন খুব ঘুম পাচ্ছে। আমাকে ঘুমুতে দে।”

“ঠিক আছে। আগে উঠে বসো তো ; তারপর আমাকে বলো সারাদিন তুমি কি ঘুমিয়েই কাটাবে?”

“যা না, কেন আমাকে বিরক্ত করছিস ?”–নূরবানু এবার চেঁচিয়ে উঠলো।

কিন্তু জয়নব কোথাও গেলো না, ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো তার গায়ে গা ঠেকিয়ে। অগত্যা, বিরক্তি সত্ত্বেও নূরবানু বললো, “ঠিক আছে, ঠিক আছে। এখানেই পানি,গামছা, বদনা, ছেলেপচি সব নিয়ে আয়। আমি আজ আর নড়তে পারছি না। আমার সারা শরীর ব্যথায় টনটন করছে।”

নূরবানুর কথাবার্তা যেন ঠিক স্বাভাবিক ঠেকছে না। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ফুফু-আম্মির সঙ্গে জয়নবের চোখাচোখি হলো। তারপর আম্মি নিজেই নূরবানুর মাথায় আদরের হাত ছুঁয়ে বললেন, “বেটি, ওঠে বাথরুম যাও, ভালোকরে মুখহাত ধুয়ে এসো। তারপর নাস্তা খেয়ে আবার আরাম করো, কেউ তোমাকে কিচ্ছুটি বলবে না।”

“না,না আজ নয়। আমি সদ্য বিবাহিতা। আমি আমার বিছানায় বসে হাতমুখ ধুবো। তারপর নাস্তা খাবো।”

আম্মির খাস বাঁদী হাজিরণ বিবি এবার নূরবানুকে পরম আদরে বিছানা থেকে নামাতে চেষ্টা করলো। কিন্তু তাকে এক ইঞ্চিও নড়াতে পারলো না।

নূরবানু এবার আম্মির দিকে তাকিয়ে বললো, “কি ব্যাপার বলতো আম্মি, তোমরা কি আমাকে বিয়ের পর একটা দিনও স্বস্তিতে থাকতে দেবে না?  নতুন বৌয়ের সঙ্গে কি কেউ কি এরকম ব্যবহার করে?” নূরবানুর কথাগুলো যেন ছুরির মতো আম্মির বুকে বিদ্ধ হলো।

আম্মি এবার হাজিরণ ও হামিশার দিকে ইঙ্গিত করলেন।  তারা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো, একটু পরেই পানির জগ, ছেলেপচি, বদনা ও তোয়ালে নিয়ে ফিরে এলো। জয়নব ট্রে-তে নাস্তা, মিষ্টি ও ফলমূল সাজিয়ে নূরবানুর বিছানায় রাখলো।

খুব স্বাভাবিকভাবে নূরবানু বিছানায় বসে হাতমুখ ধুলো, তারপর তৃপ্তি করে সবটুকু খাবারই খেয়ে নিলো। আর খাওয়া শেষ হতেই গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে বাথরুম ঢুকলো।

যখন বাথরুম থেকে সে বেরিয়ে এলো, আম্মি আশ্চর্য হয়ে দেখলেন, নূরবানু কপালের লাল টিপ, ঠোঁটের লিপস্টিক কিছুই তুলেনি, কনের সাজও খুলেনি।

আম্মি বললেন, “যাও, আবার বাথরুম যাও, এসব পোশাক চেঞ্জ করো। এই নাও তোমার নতুন পোশাক। এটা পরে বেরিয়ে এসো।” সাধারণ সুতির পোশাক দেখে নূরবানু খেপে গেলো।

“তুমি কি এবার থেকে হাজিরণ হামেশাদের মতো আমাকে চাকরানীদের পোশাকই পরাবে? কেন আমি এসব পরবো?” তারপর জয়নবের দিকে ফিরে বললো, “আচ্ছা, তুই বলতো জয়নব, কোন নব -বিবাহিতা বধূ কি এসব কখনো পরে?”

“নূরবানু , বেটি আমার, তুমি তোমার বর্তমান অবস্থাটা একটু বোঝার চেষ্টা করো। এখন থেকে সিল্ক, রেশম, জরী–এসব দামী সাজপোশাক তোমার জন্য নিষিদ্ধ।” আম্মি  তার আদরের কন্যাকে কথাগুলো বললেন বটে, তবে অজান্তে তাঁর দুই চোখ অশ্রুতে ঝাপসা হয়ে গেলো। তাঁর বুকে কে যেন অনবরত কাঁচির খোঁচা দিতে লাগলো।

হাজিরণ এবার বললো, “বাছা,তোমার তো এখন থেকে আর কোনরকম জাঁকজমক ও জমকালো পোশাক পরা চলবে না। তুমি সাধারণ সাদা শাড়ী পরবে এখন থেকে এবং সারাদিন আল্লাহর ধ্যানে মশগুল হয়ে থাকবে। এটাই তো নিয়ম বেটি।”…. হাজিরণ কথাগুলো রুটিনমাফিক বলে গেলো ঠিকই , কিন্তু তারও চোখের পানি কিছুতেই বাধ মানতে চাইলো না। হতভাগিনী নূরবানুর জন্য তার বুকের ভিতরটা তোলপাড় করতে লাগলো।

সহসা নূরবানু অনুভব করলো, মরুভূমির সমস্ত বালুকারাশি তার চারপাশে উড়তে উড়তে জমা হতে লাগলো। আর সে ক্রমেই বালির স্তুপে তলিয়ে যেতে থাকলো। …

নূরবানু স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে তখন, একদম নড়নচড়ন নেই। শুধু তার চোখেমুখে অলৌকিক এক আভার বিচ্ছুরণ গোটা হাভেলিকেই যেন গ্রাস করে নিতে চাইছে। সাইন ওয়াদি ছুটে এসে এ দৃশ্য দেখলেন, আর দুই চোখ বন্ধ করে মোনাজাতের ভঙ্গিতে উচ্চারণ করলেন, “আমেন”। সমস্ত মহিলারা আতঙ্কে এবং শ্রদ্ধায় মাথা নত করলেন।

সাইন ওয়াদি কন্যার মধ্যে ঐশ্বরিক শক্তির লীলা দেখে চমকিত হলেন এবং নিজেকে পরম সৌভাগ্যবান মনে করলেন। গর্বে তাঁর বুক ভরে উঠলো। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলেন এমন কন্যারত্নের পিতা হওয়ার গৌরব আল্লাহ তাঁকে দান করেছেন বলে। তিনি স্নেহভরা দৃষ্টিতে কন্যার দিকে চেয়ে বললেন, “মা, আজ থেকে তোমার মর্যাদা অন্যান্য সকলের থেকে অনেক বেশি। তুমি নিঃসন্দেহে সৌভাগ্যবতী, আল্লাহ তোমাকে পছন্দের পাত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছেন। আজ থেকে শুরু হলো তোমার দিব্যজীবন। তুমি সারাদিন ঘরে বসে পবিত্র কেতাব তেলোয়াত করবে। আল্লাহ তোমাকে শান্তি দেবেন।”

তারপর সাইন ওয়াদি সকল স্ত্রীলোকদের দিকে চেয়ে বললেন, “তোমরা লক্ষ্য রাখবে যাতে অধিকাংশ সময়ই সে তার হুজরাখানায় বসে থাকে, বাইরে কোথাও না যায়। সে অন্য পাঁচটা মেয়ের মতো নয়। জাগতিক বিবাহরীতি এবং স্থূল সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য পরিত্যাগ করে সে আল্লাহপ্রেমে আত্মবিসর্জন করেছে।  দু’একদিন পরেই দেখবে নানা জায়গা থেকে মেয়েরা আসতে থাকবে তার কাছে তাবিজ ও দোয়ার জন্য। তবে আমার কন্যা এখনও ছোট। তোমরা তাকে তার মর্যাদা সম্বন্ধে সচেতন করবে, সাধারণের মধ্যে থেকেও সে এখন অসাধারণ।”

সাইন ওয়াদি চলে যাওয়ার পর পরিবারের মেয়েরা তার শরীর থেকে জমকালো শাদীর পোশাক ও সমস্ত মূল্যবান অলঙ্কারগুলি একে একে খুলে নিলো। তার মুখে, হাতে, পায়ে অঙ্কিত সমস্ত বিবাহের চিহ্নগুলি মুছে দিলো। সাধারণ মানের মোটা সালোয়ার কামিজ পরিয়ে দিলো।  নূরবানু বাধা দিলো না। সে স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো, কেন তার সঙ্গে এইসব করা হচ্ছে, সে  এমন কী দোষ করেছে!

পরের দিন থেকে গ্রামের মেয়েরা আসতে লাগলো নূরবানুকে তাদের সমস্যার কথা বলে তার কাছ থেকে ইলাজ ও দোয়া নেওয়ার জন্য। কিন্তু নূরবানু কারও সঙ্গে একটি কথাও বললো না, এমনকি কারও কথা সে মন দিয়ে শুনছে কি না তাও বুঝা গেলো না। সে সারাক্ষণ শুধু ঘরের দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকলো। তবু আগত মেয়েরা কেউ হতাশ হলো না। তারা বলাবলি করতে লাগলো, “এক্কেবারে নতুন তো ! একটু সময় দাও, সব ঠিক হয়ে যাবে। সে গড়গড় করে সবার ভাগ্য পড়ে দেবে।”

নূরবানুর আম্মি তাদের বললেন, “সারাক্ষণ পবিত্র কোরান শরীফ তেলোয়াত করে এখন সে খুব ক্লান্ত। তোমরা সামনের বৃহস্পতিবার এসো, সে তোমাদের সব সমস্যার কথা শুনবে, প্রতিকারের ব্যবস্থা করে দেবে। তাবিজ ও দোয়া তার কাছ থেকে পাবে। আমার কন্যার চেয়ে পবিত্র কেউ হতে পারে না, পবিত্র আত্মা তার সঙ্গেই আছে।”

মেয়েরা চলে যেতেই আম্মি ঘনঘন ওজু করে আল্লাহর কাছে আকুতিভরা প্রার্থনা জানাতে থাকেন, “হে আল্লাহ, আমার অবুঝ কন্যার সব গুণাহ তুমি মাফ করো। তুমি তোমার নিজ করুণায় তাকে তোমার পছন্দের বাঁদী বানিয়ে নাও। তুমি সর্বশক্তিমান, অন্তর্যামী ; তার অন্তর থেকে সমস্ত খারাপ চিন্তা দূর করে দাও। হে খোদা, তাকে দয়া করো,যাতে কেউ তার বিরুদ্ধে কোন কথা বলতে সাহস না পায়।”

একদিন সকালে নূরবানু জোরে জোরে ডাকতে লাগলো, “আম্মি, আম্মি।” আম্মি কাছে আসতেই সে খুশি খুশি হয়ে ঘোষণা করলো, “আম্মি, আজ আমি সখিনার কাছে যাবো।”

“সে কি, তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে?”–আম্মি বেশ রাগতস্বরেই তাকে জিজ্ঞাসা করলেন। “না, তোমার কোথাও যাওয়া হবে না। বাড়ি থেকে বের হওয়া নিষেধ তোমার জন্য জানো না?”

“কেন? কেন আমি কোথাও যেতে পারবো না? আমি কি এখন থেকে এই জেলখানায় বন্দী হয়েই থাকবো আম্মি? কি আমার অপরাধ?”

“কেন এভাবে কথা বলছো হতভাগিনী মেয়ে? এটাই তোমার বিধিলিপি, তুমি সারাদিন ঘরের মধ্যে থাকবে, পবিত্র গ্রন্থ পাঠ করবে, কোথাও বের হতে পারবে না। বাড়ির বাইরে পা রাখা তোমার জন্য এখন নিষিদ্ধ জানো না?”

এমন সময় ছোট ভাই নাদিরকে তার ঘরের দিকে আসতে দেখে সে ছুটে গিয়ে তার কাছে অভিযোগ পেশ করলো, “দেখ তো ভাই, আম্মি আমাকে ঘরের বাইরে বের হতে দিচ্ছে না!”

নাদির তার দিকে চেয়ে বেশ কড়াভাবেই বললো, “তুমি কি জানো না তুমি এখন থেকে সৈয়দানি, কি দরকার তোমার কোথাও গিয়ে? তুমি কি এভাবে আমাদের মাথা হেঁট করতে চাও সবার কাছে ?”

নূরবানু চমকে উঠলো নাদিরের  কথায়। এ কি তার এক বছরের ছোট সেই আগের ভাই, যে সব সময় “আমি তোমার সঙ্গে খেলতে যাবো আপা, আমাকে বাইরে নিয়ে চলো বলে বায়না ধরতো? কোথাও কোন ভালো খাবার পেলে ছুটে এসে তাকে আগে না খাইয়ে খেতো না?”

নাদির একটুখানি কি যেন ভাবলো। তারপর সহসা আম্মির দিকে ফিরে বললো, “আম্মিজান, আপামণি যা কিছু চাইবে সব ঘরের মধ্যে এনে হাজির করে দিতে হবে, যাতে ওর মনে একটুও কষ্ট না হয়। সখিনার সঙ্গে যখন দেখা করতে চাইছে, তখন সখিনাবুবুর বাসায় আপনি খবর পাঠান। দেখবেন এখুনিই সে  চলে আসবে।”

নূরবানু ভাবলো, নাসির তার এক বছরের ছোট হয়েও কেমন গার্জেনের মতো কথা বলছে। আম্মির সঙ্গেও এমনভাবে কথা বলছে , যেন ও আম্মির পেটে জন্মায় নি। সে আর কিছু বললো না। এমনকি নাদির বা আম্মির দিকে একবার চেয়েও দেখলো না। সে জায়নামাজ বিছিয়ে কোরান শরীফ তেলোয়াত করতে লাগলো।

আম্মি নিজের ঘরে ফিরে এসে কপাট বন্ধ করে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। “আল্লাহ, আমার বেগুণাহ মাসুম বেটির মনে জোর দাও। তার কষ্ট যে আমি আর সহ্য করতে পারছি না মাবুদ।”

 

তিন

 

পরের দিন সকালে নূরবানু রাজী হলো বাইরে থেকে আসা মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে। সঙ্গে সঙ্গে তার সাক্ষাতপ্রার্থী মেয়েদের মনে আনন্দের হুল্লোড় বয়ে গেলো। একে একে তার কাছে যাওয়ার অনুমতি পেলো তারা। একজন বললো, তার ছেলের রোগ কিচ্ছুতেই সারছে না, ডাক্তাররাও রোগ ধরতে পারছে না। অন্যজন আন-নারীতে আসক্ত তার স্বামীর চরিত্রদোষ সংশোধনের জন্য তাবিজ চায়। একজন দুবাই যেতে চাওয়া ছেলের পাসপোর্ট যাতে হয় তার জন্য দোয়া চায়। আর একজন বয়স্ক মহিলা এসেছে দজ্জাল শাশুড়ির হাতে নিত্য নির্যাতিত কন্যার জন্য ইলাজ চাইতে।

এইভাবে শুরু হয়ে গেলো নূরবানুর আধ্যাত্মিক জীবন। দিনকে দিন ভিড় বাড়তে লাগলো। একজন খাস বাঁদী নিযুক্ত হলো ভিড় সামলানো এবং নূরবানুর ফাইফরমাশ শোনার জন্য।

একদিন সকালে নূরবানুর দৃষ্টি পড়লো অন্যান্য মেয়েদের সারিতে বসে থাকা সখিনার দিকে। তার বাল্য সহচরী সখিনা, প্রাণের বন্ধু সখিনা,দূর থেকে তাকে শুধু দেখছে। তার দৃষ্টিতে সম্ভ্রমমিশ্রিত বিস্ময়। নূরবানু তাকে কাছে ডাকলো  এবং নিজে উঠে গিয়ে দরজার সামনে থেকে হাত বাড়িয়ে তাকে ভিতরে ঢুকিয়ে নিলো। তারপর গাঢ়ভাবে আলিঙ্গন করে বললো, “সখিনা , আমার প্রাণের সই সখিনা, কেমন আছিস তুই?”

সখিনার বিস্ময়ঘোর তখনও কাটেনি, মোটা সূতির সাদামাটা সালোয়ারকামিজ পরিহিতা, অলঙ্কারশূন্য এ কোন নূরবানু? এই কি তার জীবনের সেরা বান্ধবী সেই  নূরবানু যাকে পেলে ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যেতো, সময়ের খেয়াল থাকতো না , এ-কি সেই?

নূরবানু ও সখিনার জীবনে বোধহয় সবটাই মিল, অমিলের সংখ্যা নেই বললেই চলে। কারণ তারা একই দিনে জন্মগ্রহণ করেছিলো, একই সঙ্গে শৈশব কাটিয়েছিলো, একই মক্তবে পড়েছিলো, এমনকি তাদের দু’জনের শরীরে একই সঙ্গে চিকেনপক্স বেরিয়েছিলো। আর একটি বিস্ময়কর ব্যাপারও ঘটেছিলো, দু’জনে খেলতে খেলতে একই সঙ্গে একবার হোঁচট খেয়েছিলো এবং তাদের ডান পায়ের বুড়ো আঙ্গুল সামনের দিকে কিছুটা উঠে যাওয়ায় রক্তপাত হয়েছিলো। তাদের ঘা শুকোতেও সমান সময় লেগেছিলো। সবাই তাদের দেখলে মজা করে বলতো, ‘মানিক-জোড়’, কী মিল দু’জনে! তারপর তাদের দু’জনের বিয়ের দিন একই সঙ্গে ঠিক হয়েছিলো এবং একই দিনে তাদের নিকাহপর্ব সম্পন্ন হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছিলো। …..

তারপর…! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সখিনা; অমিল শুধু একটা জায়গায়,তার বিয়ে হলো এক প্রাণচঞ্চল যুবকের সঙ্গে আর নূরবানুর বিয়ে হলো পাক কিতাবের সঙ্গে।

“এতোদিন কোথায় ছিলি সখিনা? আমি তো আম্মিকে প্রায়ই তোর কথা বলি। সেই যে বিয়ের পর ডুব মারলি, আর দেখা নাই। এবার বল,তোর ‘তিনি’কেমন হলো? তাকে নিয়ে নিশ্চয়ই খুব সুখে আছিস –তাই না !  নাহলে আমার মতো ছোটবেলার  সইকে কি তুই ভুলে থাকতে পারতিস?”

“ভুলিনি তো! সবসময়ই তোর কথা মনে পড়ে। তাই তো আর থাকতে পারলাম না, চলে এলাম তোর কাছে,–কথাগুলি বলে সখিনা দুষ্টু দুষ্টু মুখ করে চেয়ে থাকলো।

মিচকি হেসে নূরবানু বললো, “ও তোকে সে মিয়া বুঝি এতো এতো ভালোবাসে যে, একমুহূর্তও কাছ ছাড়া করতে চায় না! আর তুইও বুঝি এতো ভালোবাসিস যে সবসময় তার মুখে মুখ দিয়ে বসে থাকতে ভালো লাগে! বল, সত্যি বলছি কি না?”

সখিনা কোন উত্তর দিলো না, শুধু মাথা নাড়লো; কিন্তু তার সারা মুখমন্ডল খুশিতে চকচক করতে লাগলো। বোঝা গেলো বিবাহিত জীবনে সে খুব খুশি।

তবু শীঘ্রই তার মুখে একটা বিষণ্ণতার ছাপ স্পষ্ট বোঝা গেলো। সে বন্ধুকে পাল্টা প্রশ্ন করতে পারলো না তার বিবাহিত জীবন সম্পর্কে। অব্যক্ত যন্ত্রণায় তার বুকটা যেন ফেটে পড়তে চাইলো। শুধু জোর করে ঠোঁটে শুকনো হাসি এনে বান্ধবীকে জিজ্ঞাসা করলো, “কেমন আছিস তুই?”

“আমি!” …খুব ভালো, খুব ভালো, এতো… এতো ভালো আছি যে …. কী বলবো”–হঠাৎ দমকা হাসিতে ফেটে পড়লো নূরবানু। সে হাসি যেন থামতেই চায় না, এতো উচ্চকিত সে হাসি যে, সারা হাভেলিময় তা ছড়িয়ে পড়লো। বাইরে অপেক্ষারত মহিলারা চমকে একে ওপরের মুখের দিকে চেয়ে রইলো।

কিছুক্ষণ পর নূরবানুর হাসি থামলে সখিনা বললো, “আমাকে একটা দোয়াতাবিজ দিলে খুব ভালো হয়।” নূরবানু নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারলো না। সখিনাও অন্যান্য মেয়েদের মতোই শুধুমাত্র একটা তাবিজের জন্য তার কাছে এসেছে! অস্ফুটে তার মুখ শুধু বের হলো,”সখিনা, শেষ পর্যন্ত তুইও!”  আর বলতে পারলো না, তার জিভ যেন আড়ষ্ট হয়ে গেলো, চোখের কোণে দু’ফোঁটা অশ্রু চিকচিক করতে লাগলো। তার মনে হলো এখনিই বুঝি তার বুকটা খানখান হয়ে ফেটে পড়বে।

সখিনা সবই বুঝলো। সে তার আবেগকে যথাসম্ভব ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরলো। যদিও একটু কাঁপা কাঁপা মনে হলো, তবুও সে যেন স্পষ্ট করেই বললো, “নূরবানু , তুই তো এখন আমাদের মতো সাধারণ নোস্। স্বয়ং পবিত্র আত্মা তোর সঙ্গে রয়েছেন। তোর দোয়ার বরকতে শুকনো গাছেও ফল ধরতে পারে। অসম্ভব অলৌকিক শক্তির প্রতীক এখন তুই , মহাতাপসী, মহাসাধিকা আল্লাহর পায়ে নিবেদিতা অলিআল্লাহ তুই।”

নূরবানুর ঠোঁটে এক চিলতে শুকনো হাসি দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেলো। সখিনার স্তুতি বিষাক্ত ছোবলের মতোই তার বুকে একের পর এক ক্ষত সৃষ্টি করে চললো। ব্যক্তিগত যন্ত্রণাকে অসম্ভব দৃঢ়তার সঙ্গে চেপে সে সখিনার দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলো , “বল আমি তোর জন্য কি করতে পারি? কিসের সমস্যা তোর?”

বলতে গিয়ে সখিনা বার কয়েক ঢোক গিলে চোখ বন্ধ করেই এবার বলে ফেললো, “খুব জবরদস্ত একটা তাবিজ লিখে দে যাতে আমি তাড়াতাড়ি পুত্রবতী হতে পারি। এতোদিন বিয়ে হয়ে গেলো, এখনও কোন সন্তান হলো না। পরিবারের সবাই এজন্য খুব উদ্বিগ্ন। এমনকি আমার স্বামীও চায় যাতে আমি একটি সুস্থ, সবল ও সুন্দর পুত্রসন্তানের জন্ম দিতে পারি।”

“ও এই কথা!”–এতো সাধারণ কথা সখিনা বলতে পারে বলে সে আশা করে নি। সে একটু উদাসীন কণ্ঠে সখিনাকে জিজ্ঞাসা করলো, “আমি চাইলেই তোর পেটে  বাচ্চা এসে যাবে কী করে ভাবলি !”

সখিনার চোখ এবার সত্যিই ছলছল করে উঠলো, কোনক্রমে ঢোক গিলে সে নূরবানুকে মিনতির সুরে বললো, “তুই আমার প্রাণের সই; আল্লাহর পেয়ারা খুশনসিবওয়ালি তুই, তুই দোয়া করলেই আল্লাহ আমার দিকে মুখ তুলে চাইবেন। নইলে শ্বশুর বাড়িতে আমার গঞ্জনার একশেষ থাকবে না সই।”

নূরবানু একবার তার মুখের দিকে চেয়ে বিড়বিড় করে পবিত্র আয়াত পড়ে সখিনার পেটের চারপাশে তার কোমল হাত বুলিয়ে তিনবার ফুঁ দিলো। তারপর সখিনার দিকে আর একটি বারের জন্যও না চেয়ে বললো , “এবার যাও , খোদা তোমার মনস্কামনা পূরণ করবেন।”

যাবার সময় সখিনা একবার পিছন ফিরে বললো, ”আমি ওয়াদা করছি সই, যদি আমি পুত্রের জননী হতে পারি সর্বপ্রথম সন্তানসহ মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে তোর দরবারে এসে হাজির হবো।”

নূরবানু সে কথার উত্তর দিলো না। মুখ ঘুরিয়ে নিজের কষ্টটাকে শুধু চেপে রাখলো। উদ্গত অশ্রু দুই চোখ প্লাবিত করে নেমে আসতে চাইলো, নূরবানু বাধা দিলো না। শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অস্ফুটে উচ্চারণ করলো, “হে আল্লাহ, তুমি দুঃখিনীর মনস্কামনা পূরণ করো।”

এরপর অনেক দিন সখিনা তার কাছে আসেনি। নূরবানু একবার বাঁদী মারফত খবর নিলো, সখিনার এখন পূর্ণ গর্ভাবস্থা, শ্বশুর বাড়ির লোকজন  তাকে চোখে চোখে রাখছে। তার আদর-যত্নও বেড়ে গিয়েছে। শুনে নূরবানু শুধু বললো, “শুকরিয়া”।

তারপর সখিনা যখন সত্যি সত্যিই আসলো তখন তার কোলে গৌরবর্ণ, নাদুসনুদুস দারুণ সুন্দর একটি পুত্র, যেমনটি সখিনা ও তার শ্বশুর বাড়ির লোকজন চেয়েছিলো।

নূরবানু দু’হাত বাড়িয়ে বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে বুকে চেপে ধরলো। সখিনা বললো, “এ বাচ্চা শুধু আমার নয়, তোরও। কেননা দুনিয়ার মালিক তোর কথা শুনে একে দিয়েছেন। তাই যেমনটি চেয়েছিলাম ঠিক তেমনটিই হয়েছে ও। সব লোক তোকে ধন্য ধন্য করছে, বলাবলি করছে সত্যিই তুই আল্লাহওয়ালি সই।

নূরবানু কোন উত্তর দিলো না, শুধু বাচ্চাটিকে বুকের সঙ্গে নিবিড় করে জড়িয়ে বুভুক্ষু মাতৃতৃষ্ণা মিটিয়ে নিলো কিছুক্ষণ। তারপর আবার বাচ্চাটিকে ফিরিয়ে দিলো তার মায়ের কোলে। তবুও তার মনে হলো, তার বুকের মধ্যে এখনও ঐ শিশুর ক্ষুদ্র শরীরের উত্তাপ লেগে রয়েছে।

পরের দিন দুপুরে বিরাট ঝড়-ঝঞ্ঝা শুরু হলো।মেঘের গর্জনে আর বাতাসের সোঁ সোঁ শব্দে মনে হলো, পৃথিবীতে যেন কিয়ামত নেমে এসেছে। অধিকাংশ মাটির বাড়ি ভেঙে পড়লো, করগেটের চালগুলো উড়ে গেলো, দুর্বল ইটের পাঁচিলের ঘরগুলোও ধূলিসাৎ হলো। বহু গাছপালা বিনষ্ট হলো, অনেক গবাদি পশুর খোঁজ পাওয়া গেলো না। শুধু নূরবানুদের হাভেলি অটুট  রইলো। তার ভিতরের বাসিন্দারা বুঝতেও পারলো না বাইরে অমন প্রলয় কান্ড ঘটে গিয়েছে। সকলে একে নূরবানুর তেলেসমাতি ব্যাপার বলে প্রচার করতে লাগলো।

সেদিন হাভেলির বাসিন্দাদের একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়ার আমন্ত্রণ ছিলো। তাই সকাল সকাল স্নান সেরে পরিষ্কার-পরিছন্ন সাজগোজে ব্যস্ত ছিলো তারা তখন। আত্মীয়াস্বজনদের আনাগোনাও লেগে ছিলো। সাইন ওয়াদির ভাগ্নির বিয়ের দিন ছিলো সেদিন। তার মধ্যেই ওই ঝড়ের তান্ডব। অথচ কি আশ্চর্য! খোদার কুদরতিতে অতবড় প্রাকৃতিক দুর্যোগেও হাভেলির লোকজনদের তিলমাত্র ক্ষতি হলো না। স্বভাবতঃই সাইন ওয়াদির মনে কন্যারত্নটির জন্য একটু গর্বও  হয়েছিলো বোধহয়। তাই নূরবানুর বিয়ে বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছায় খুব একটা বড় বাধা হয়ে দাঁড়ালেন না তিনি।

নূরবানু আজ সত্যিই খুব খুশি। কারণ বহুদিন পর সে বাইরে যেতে পারবে। তার আম্মি তার আব্বা সাইন ওয়াদির অনুমতির ব্যাপারটা তাকে আগেই জানিয়ে দিয়েছেন। শুনে নূরবানুও প্রথমটা বিশ্বাস করতে পারে নি কী করে তার ভাগ্য এতো সুপ্রসন্ন হলো!

সুন্দর জমকালো জরির কাজ করা পোশাক নিয়ে এসে নূরবানু আম্মিকে জিজ্ঞাসা করলো, “আমি আজ এটা পারবো?” আম্মি মেয়ের দিকে চেয়ে দেখলেন, বহুদিন পর সে যেন সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি হয়ে উঠেছে। আর উচ্ছল  আনন্দে মেয়ে যেন টগবগ করে ফুটছে। “কোথায় পেলে তুমি এ পোশাক ? কে দিলো তোমাকে এতো সুন্দর সাজ?”–আম্মি জিজ্ঞাসা করলেন।

“ফুপি-আম্মি এটা আমার পোশাক। আমি আমার প্রিয় আপামণিকে পরতে দিয়েছি। তুমি অমত করো না, অন্ততঃ আজকের এই বিশেষ দিনটির কথা ভেবে তুমি অনুমতি দাও।” ভ্রাতুষ্পুত্রী জয়নাবের কথায় আম্মির অবশ্য চিন্তা বেড়ে গেলো। তাঁর মন তো চাইছে তাঁর বেহেস্তের হুরীর মতো কন্যা এই পোশাকে বিয়েবাড়ি যাক। কিন্তু ওর আব্বা সাইন সাহেব হুকুম দেবেন কি?

“আমি একটা চাদরে নিজেকে ঢেকে নিয়ে যাবো আম্মি, কেউ আমার এ পোশাক দেখতেও পাবে না।” নূরবানু যেন আম্মির মুশকিল আসান করার জন্য উপায় বাতলিয়ে দিলো।

একটা সুন্দর পোশাকে তাঁর মেয়ে যে কতো সুন্দরী হয়ে উঠতে পারে তা স্বচক্ষে দেখেও আম্মির অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস পড়লো। এ সৌন্দর্যের কাছে বসরাই গোলাপও হার মানবে, চাঁদও  মুখ ঢাকবে লজ্জায়। অথচ তাঁর এই পরীর মতো খুবসুরত বেটি কতই না বদনসীব নিয়ে দুনিয়ায় পয়দা হয়েছে, তার রূপের কদর করার জন্য কেউ নেই।

এসবের পরেও যখন অমরকোটের বিবাহ-অনুষ্ঠানে তাঁরা সপরিবারে পৌঁছলেন, তখন সত্যিই একটা বিরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো এবং শেষ পর্যন্ত আম্মির আশংকাই সত্যে পরিণত হলো। নূরবানুর ঝলমলে পোশাক দেখে প্রথমে মেয়েমহলে একটু ফিসফাস, পরে চাপা গুঞ্জন উঠলো।

নূরবানু নিজের আনন্দেই মশগুল, কে কোথায় কী বলছে সেদিকে কোন খেয়ালই নেই। সে সমবয়সী সব মেয়েদের সঙ্গে হেসে হেসে স্বাভাবিক কথাবার্তা বলে আনন্দ ও হৈহুল্লোড়ে মেতে গেলো। কেউ সেভাবে না ডাকলেও সে নিজেই সকলের সঙ্গে ভাব জমাতে চাইলো। এমনকি তাদের সঙ্গে বিয়ের গানেও অংশ নিতে এগিয়ে গেলো এবং তাদের সঙ্গে নাচের তালে পা মিলিয়ে, কোমর বেঁকিয়ে, নয়নে কটাক্ষ হেনে এমন উদ্দাম নৃত্য শুরু করে দিলো যে, বয়স্করা বাকরহিত হয়ে গেলো, বাচ্চারা আনন্দে হাততালি দিয়ে লাফাতে লাগলো। তখন মেয়েমহলের চাপা গুঞ্জন আর চাপা থাকলো না, প্রতিবাদের ঝড় উঠলো। তড়িৎ বেগে আম্মি এসে মেয়ের পাশে দাঁড়ালেন,  “আসলে ও তো এখনও বাচ্চা।”

আম্মির কথায় তেমন কাজ হলো না। একজন বয়স্ক মহিলা ঝাঁকিয়ে উঠলো,  “পাক কিতাবের সঙ্গে যার শাদী হয়েছে সে এসব কী করে করতে পারে?”  অন্যজন আবার চেঁচিয়ে বলতে লাগলো, “ এইজন্যই …..এইজন্যই এইসব মেয়েদের আগেকার দিনে পায়ে শিকল পরিয়ে রাখা হতো, যাতে সারা দিনরাত তারা পবিত্র গ্রন্থ পাঠ করে, কারও কুদৃষ্টি তাদের উপরে না পড়ে।” কোন কোন ঠোঁটকাটা মেয়ে এও বললো, “এইসব নিলাজ মেয়েদের, যারা পাক কিতাবের ইজ্জত বুঝে না, তাদের আনা হয় কেন? শাদীর খুশি যে এইসব মেয়েদের জন্য নিমেষে গুমিতে বদলিয়ে যেতে পারে তা কি হতভাগিনীদের মায়েরা জানে না!” এইভাবে চুতুর্মুখী আক্রমণে আম্মি যেন সম্বিতহারা হয়ে গেলেন। তাঁর মনে হলো এক দঙ্গল মানুষ খুন্তি-ছুরি-দা-কাটারি দিয়ে তাঁর হৃৎপিণ্ডকে যেন উপড়িয়ে নিতে চাইছে।

এইসময় কনের মায়ের আওয়াজ এলো, “কই গো, সাতজন এয়োতি মেয়ে এদিকে এসো তো, কনেকে হেনা মাখাতে হবে।”

সঙ্গে সঙ্গে বিন্দুমাত্র দ্বিধা-সংকোচ না করে নূরবানু অনেকটা লাফিয়ে কনের কাছে গিয়ে হাজির হলো। ডিব্বা থেকে হেনা নিয়ে কনের হাতে মাখাতে মাখাতে গুনগুন করে বিয়ের গীত শুরু করে দিলো।

কনের মা এই অনাচার দেখে ক্ষিপ্ত বাঘিনীর মতো ছুটে এলো নিজের শাবককে রক্ষা করার জন্য এবং নূরবানুকে হাত দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলো।

“তুমি কি পাগলা হয়ে গিয়েছো, তোমার বুদ্ধিশুদ্ধি একেবারেই লোপ পেয়ে গিয়েছে? “ নূরবানুকে বকতে বকতে কনের মা চিৎকার করে ডাকলো তার আম্মিকে,  “ফাতেমা, দেখতে পাচ্ছো না তোমার বেটির বেআক্কেলে কান্ডকারখানা। নিজের মেয়ের কপাল পুড়িয়ে এখন আমার মেয়ের কপাল পুড়ানোর জন্য ওকে এখানে নিয়ে এসেছো, লজ্জা করে না, ছিঃ!” কনের মা রাগে ফুঁসতে লাগলো।

নূরবানুর আম্মি ফাতেমা ভীত-সন্ত্রস্ত হরিণীর মতো তৎক্ষণাৎ ছুটে এসে কান্নাভেজা কণ্ঠে ননদের কাছে আকুতি মিনতি করতে লাগলেন, “জাকিয়া বোনটি আমার, ছেড়ে দাও ব্যাপারটা, আর শোরগোল কোরো না । দেখো, ও শুধু মাথায় একটু বড় হয়েছে, কিন্তু এখনও ছোট্ট শিশুটিই আছে। আমি এখনই ওকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, তুমি চুপ করো।”

আম্মি নূরবানুকে ঠেলতে ঠেলতে ঘরের বাইরে নিয়ে গেলেন এবং শুনলেন চারিদিক থেকে তাঁর মেয়েকে নিয়ে হাসিঠাট্টা ,ব্যঙ্গবিদ্রুপ চলছে। আম্মি চিৎকার করে ডাকলেন  “হাজিরণ, হাজিরণ।”

হাজিরণ কাছে আসতেই তিনি বললেন, “তাড়াতাড়ি ড্রাইভারকে ডাকো এবং একে সঙ্গে করে বাড়ি চলে যাও। নইলে আমাদের সকলের মানসম্মান ও ধুলোয় মিশিয়ে ছাড়বে।”

গাড়িতে উঠে সারাটা পথ নূরবানু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকলো। হাজিরণ তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বৃথাই শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলো। সে বললো, “দেখো নূরবানু, তুমি তো আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতো নও। পাক কিতাবের সঙ্গে তোমার শুভ শাদী মোবারক সুসম্পন্ন হয়েছে। তোমার নিজের এবং গোটা পরিবারের মানসম্মান, ইজ্জতআব্রু সবই তো তোমরা উপর নির্ভর করছে বেটি। ছিঃ, এমন করে কাঁদতে নেই। এমন করে কাঁদলে সবার যে অকল্যাণ হবে মা।”

নূরবানু হাজিরণের কাঁধে মাথা রেখে আরও কিছুক্ষণ কাঁদতে কাঁদতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লো। গাড়ির কাঁচ ভেদ করে হাজিরণের দৃষ্টি পড়লো আকাশের দিকে। পূর্ণিমার চাঁদ যেন তার ষোলো কলার পূর্ণ সৌন্দর্য নিয়ে মিটিমিটি হাসছে, ঢাকাও পড়ে যাচ্ছে মাঝে মাঝে, যেন লুকোচুরি খেলছে, যেমন করে নূরবানু আগে খেলতো। হাজিরণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে বললো, “আহা! আমাদের নূরবানু চাঁদের থেকেও সুন্দর–কেউ তার কদর বুঝলো না!”

রাস্তা প্রায় শেষ হয়ে এলো। হাভেলির সংরক্ষিত এলাকায় তাদের নামিয়ে দিয়ে ড্রাইভার গাড়ি পার্কিং-এ নিয়ে গেলো। হাজিরণ বয়স্ক মহিলা। সারাদিন ধকলের  পর তার পা যেন আর চলতেই চাইছে না। সে নূরবানুকে তার ঘরে পৌঁছে দিয়েই নিজের ঘরে চারপা খাটিয়ার উপর শুয়ে পড়লো। আর শোওযার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লো এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই তার নাক ডাকতে আরম্ভ করলো। নূরবানুর ঘুম এলো না, কিছুক্ষণ এপাশওপাশ করে  ঘরের দরজা খুলে বাইরে এলো। সঙ্গে সঙ্গে একরাশ চাঁদের আলো তাকে অভ্যর্থনা জানালো। জমকালো শাদীর মতো পোশাক শরীর থেকে খোলার আগে নূরবানু বড় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। তার শরীর থেকে যেন সৌন্দর্যের আভা ঠিকরে বেরুচ্ছে। এই অতুলনীয় রূপ মাধুরী দিয়ে কে তাকে দুনিয়ায় পাঠালো, কেনই বা পাঠালো? যদি তার রূপসুধা পান করার মতো কোন ভ্রমরই না থাকে, তবে সে রূপের কী দাম!

নূরবানু ঘরের মধ্যে নাচের ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ ঘুরতে লাগলো। অজান্তেই তার  পা থেকে ঝনাৎ ঝনাৎ শব্দ সারা ঘরময় ছড়িয়ে পড়লো। গুনগুন করে সে একটা শাদী-সংগীতের সুর ভাঁজতে লাগলো। এতো মিঠা ও মন কেমন করা সুর যে, নূরবানু একটা নেশার মতো আমেজ সারা শরীরে অনুভব করতে লাগলো।  হঠাৎ বিদ্যুৎ-বিভ্রাট! গভীর ঘন অন্ধকার ঘরময় ছড়িয়ে পড়লো। নূরবানু কিছুই দেখতে পাচ্ছে না আর। তবুও তার মনে হলো, অন্দরের বাইরে গোটা চবুতরা জুড়ে যেন অজস্র পায়ের নূপুরের ছন্দ–বেজেই চলেছে ঝনাৎ ঝনাৎ…..।

সে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো। তারপর রেলিং-বারান্দা দিয়ে হেঁটে কোনক্রমে রান্নাঘর হাতড়িয়ে দেশলাই কাঠি ও মোমবাতি নিয়ে এলো। গভীর নিশুতি রাত। কিন্তু জোৎস্নার আলোয় হাভেলির চত্বরের প্রায় পুরোটাই দৃশ্যমান। সে দেখলো বেশ কিছু চাকর শ্রেণীর মানুষরা শুয়ে আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। তাদের নাক ডাকার শব্দ আসছে। সকলে দড়ির খাটে গাঢ় আয়েসে চরম প্রশান্তিতে ঘুমুচ্ছে। অথচ সে বিশাল পালঙ্কে শুয়ে সারা রাত এপাশ ওপাশ করে, মাঝে মাঝে এতো অস্থিরতা তাকে পেয়ে বসে যে, ঘুম আসে না। সে তখন জোরে জোরে পবিত্র গ্রন্থ পাঠ করতে থাকে।

বাড়িতে এখন কোন অভিভাবক শ্রেণীর কোন মানুষ নাই। সে এখন একাই এ বাড়ির মালকিন। খুশিমতো সে বাড়ির চারপাশটা অনায়াসেই দেখতে পারে এখন। তাকে বাধা দেওয়ার জন্য কেউ নাই। হাজিরণ আছে বটে, তবে সেও গভীর ঘুমে অচেতন।

বহুদিন পরে সে এখন এ স্বপ্নপুরীর স্বপ্ন কন্যা। যেখানে খুশি সে যেতে পারে।  হঠাৎ বিশাল মোমবাতিটা হাতে নিয়ে গোটা হাভেলিটা ঘুরে ঘুরে দেখার ইচ্ছা জাগে তার মনে। তার ইচ্ছাকে দমিয়ে দেওয়ার জন্য এ বাড়িতে এখন কেউ নেই। যদিও এই বাড়িতেই তার জন্ম, সে কখনও জেনানামহলের বাইরে পা দেয়নি। তাকে বোঝানো হয়েছিলো সে একটা মেয়ে, মেয়েদের জন্য সংরক্ষিত এলাকার বাইরে কখনই পা দেওয়া তার উচিত নয় তার। না, আজ সে এসব কিছু মানবে না। সে দেখবে কেমন নিষিদ্ধ সেই জগতটা যেখানে যেতে তাকে বারবার নিষেধ করা হয়।

সে দেখলো পুরুষ এলাকার প্রধান ফটকে আজ চাবি দেওয়া হয়নি। বালিকাসুলভ কৌতূহল তার মনের সুপ্ত খেয়ালকে উস্কে দিলো। সে মোমবাতি হাতে বেরিয়ে এলো। ফটক পেরিয়ে ভিতরে ঢুকলো। ধীর পায়ে চারিদিক চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগলো। হঠাৎ এক আশ্চর্য মনোরম সুগন্ধ যেন বাতাসে ভেসে এলো। সে সেটা লক্ষ্য করে এগুতে থাকলো। তার উৎস সন্ধানের অদম্য বাসনা পেয়ে বসলো তার মনে। সে দেখলো অতিথিশালার ঘরগুলো আজ  প্রায় ফাঁকা। দূর দূর থেকে যারা এসেছিলো তারা হয়তো সকলে চলে গিয়েছে অমরকোটের বিয়ে বাড়িতে যোগ দিতে।

কিন্তু কোন এক অজানা  চুম্বকীয় সুগন্ধ তাকে যেন ক্রমশঃ ভিতরের দিকে টানছে। যেন কোন অব্যর্থ শিকারীর নিশানায় পড়েছে সে। এগিয়ে যেতে যেতে একটা ঘরের সামনে হঠাৎ থেমে গেলো তার গতি। কোন মানুষের মতো কেউ যেন সেখানে শুয়ে আছে। হয়তো বা কোন অতিথি হবে। অযথা দেরী করে পৌঁছনোর জন্য আটকিয়ে পড়েছে, বিয়েবাড়ি যাওয়া বেচারির পক্ষে আর সম্ভব হয়নি। কিন্তু না, সেরকম তো মনে হচ্ছে না। এ যে অনিন্দ্যকান্ত এক যুবাপুরুষ! না, হয়তো ভুল দেখছে সে। এ তো দিব্যপুরুষের মতোই দেখতে । কেননা মানুষের  এতো সৌন্দর্য হতে পারে না। নূরবানু মোমবাতিটা উস্কে দিয়ে আরও কাছে এগিয়ে গেলো। দেখলো লম্বা জ্যোতির্ময় দু’টি হাত বুকের উপর রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে সে।  তার শরীরে যেন বিদ্যুতের ঢেউ রূপের ঝলক হয়ে ঝরে পড়ছে।

না, নূরবানু আর এগুবে না কিছুতেই। কাছাকাছি গেলে সে এখনিই পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। নূরবানুর ভিতরে তোলপাড় শুরু হয়ে গেলো। মনে হলো সে যেন হঠাৎই এক অজানা জগতে চলে এসেছে। কোন এক নির্জন দ্বীপে বসে আছে সে। তার চারপাশে শুধু সমুদ্রের ঢেউ,  মিষ্টি মহুয়ার সৌরভ, লাখো লাখো গোলাপের পাপড়ি ঝরে পড়ছে আকাশবৃষ্টির মতো। চারিপাশে অকাল বসন্তের স্পষ্ট ছাপ। এ যে নন্দনকানন! আদম-হাওয়ার  বেহেশতের সেই পহেলা বাগিচা। বৃক্ষের শাখায় শাখায় কোকিলের কুহু কুহু স্বর, পাখিদের কলকুঞ্জন।

হঠাৎ তার হাতের মোমদানি থেকে উত্তপ্ত মোমের একটি ফোঁটা ঐ অনিন্দ্যপুরুষের বাহুতে গিয়ে পড়লো। আর সঙ্গে সঙ্গে তার ঘুম ভেঙে গেলো। চোখের সামনে পরীর মতো সুন্দরী এক নারীকে দেখে সে ভাবলো, “এ আমি কী দেখছি! আমি কি স্বপ্ন দেখছি! যদি এটা সত্যিই স্বপ্ন হয়, তবে কোনদিনই যেন আমার ঘুম আর না ভাঙে। স্বপ্নের মধ্যেই যেন আমার মৃত্যু হয়।”

নূরবানুরও মনে হলো সে যেন আজব এক স্বপ্ন পুরীতে এসে গিয়েছে। এখানে আলো নেই, অন্ধকার নেই, আছে শুধু স্বপ্ন, আর চারিদিকে ভেসে বেড়ানো স্বপ্নের মায়ামেঘ। ক্রমে সেই আশ্চর্য মেঘ উড়ে এসে দু’টো শরীরকে ছায়ায় মতো ঘিরে ধরলো। স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে কেটে  গেলো নূরবানুর বেশ কিছুটা সময়। সে চাইলো আরও সময়, আরও, আরও…অনন্ত এক দিব্য ছোঁয়ায় ভরে গেল তার মন।

 

চার

কিছুদিন পরে নূরবানুর মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেলো। সে যখন তখন তার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে উদাস নয়নে বাইরের দিকে চেয়ে থাকে। আকাশের ভাসমান মেঘগুলো মায়ামেঘ হয়ে তার ঘরের বিশাল জানলার রেলিংগুলো দিয়ে মাঝে মধ্যেই ঢুকে পড়ে। নূরবানু স্পর্শ করার চেষ্টা করে, তার শরীর ঘেমে ওঠে,পা টলে। হাঁটতে গেলে কখন কখন  মনে হয় এখুনিই যেন মাথা ঘুরে পড়ে যাবে।

নূরবানু বিরাট সুসজ্জিত পালঙ্কে নরম গদির বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। এপাশ ওপাশ করে, কখন বা হাত বাড়িয়ে কোন কিছু ছুঁতে চায়, পেয়েও যায়। এক অশরীরীর নিবিড় ছোঁয়ার আমেজে চোখ বন্ধ করে, বুকের  মধ্যে তার স্পর্শ অনুভব করে , তৃপ্তির আনন্দে কখনো বা নিজের মনেই হেসে উঠে।

তবে ইদানীং নূরবানু সেভাবে আর খেতে চাইছে না। হাজিরণের মুখে সংবাদটা শুনে আম্মির উদ্বেগ বাড়ে। তবে আম্মি নিজের মনকে প্রবোধ দেন, এমনটা হতেই পারে, সবসময় মেয়ে তো ঘরের মধ্যেই থাকে, বাইরের আলো বাতাস পায় না। তাই হয়তো শরীর খারাপ হয়েছে।

কিন্তু যখন খবর আসতে থাকলো যে নূরবানুর খাওয়ার প্রবৃত্তি দিনদিন কমে যাচ্ছে, যখন তখন বমি বমি ভাব আসছে, তখন আম্মি হাজিরণকে ডেকে বিস্তারিতভাবে সব জেনে নিয়ে কিছুটা দুশ্চিন্তায় পড়লেন। ভাবলেন, মেয়ের হয়তো সত্যিই কোন জটিল রোগ হয়েছে। হয়তো এমন কোন খাবার খেয়েছে যা থেকে ফুড-পয়জন হয়ে গিয়েছে, কিছুতেই সারতে চাইছে না। আম্মি স্থির করলেন যাকে তাকে না দেখিয়ে শহরের নামী কোন লেডি ডাক্তারকে দেখানোই ভালো। অবশ্য ঐ পর্যন্তই। এর অধিক কোন দুশ্চিন্তা আম্মির মনে স্থান পেলো না।

দু’চার দিন পরেই শহর থেকে বিলাত ফেরত ফিমেল-স্পেশালিস্ট লেডি ডাক্তার এলেন। তিনি নূরবানুকে ভালো করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে স্মিত হেসে বললেন, “কোনরকম দুশ্চিন্তার কারণ নেই, মেয়ের শরীর একদমই ফিট আছে। এই কিছু ওষুধপত্র লিখে দিচ্ছি, এগুলো খেলে সবসময় চাঙ্গা থাকবে। আর এই অবস্থায় মেয়েদের যা যা ঘটা উচিত ওর সেরকমই ঘটছে।

লেডি ডাক্তার ভাবলেন, তিনি মেয়ের মাকে একটি জব্বর খবর দিয়েছেন। কিন্তু আশ্চর্য উল্টো ফল হয়ে গেলো। আম্মির চোখের সামনে যেন বিশ্বজগত টলতে লাগলো। মাথা ঘুরে তিনি প্রায় পড়েই যাচ্ছিলেন, পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হাজিরণ তাকে দ্রুত ধরে ফেললো। কোনমতে তিনি টাল সামলিয়ে নিলেন। কিন্তু তার সারা শরীর কাঁপছিলো, ক্রোধের আগুন তার দুই চোখ ঠিকরে যেন বেরিয়ে আসতে চাইছিলো।

হাজিরণ ও জয়নব ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লো, না জানি এখুনিই কি ঘটে যায়! তারা টানতে টানত আম্মিকে ঘর থেকে বের করে তার নিজের ঘরে নিয়ে গেলো। জয়নব ফুফু-আম্মির হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। আম্মি একটা কথাও বললেন না। তাঁর শাহী খানদানের রক্ত সারা শরীরে টগবগ করে ফুটতে লাগলো। কিন্তু মুখে একটি শব্দও করলেন না। ভীত হাজিরণ ও জয়নব আম্মিকে কিছুক্ষণ একা থাকতে দেওয়াই সমীচীন মনে করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

আম্মি তাঁর ঘরের মধ্যে কিছুক্ষণ অস্থিরভাবে পায়চারি করতে করতে একসময় হঠাৎই নূরবানুর ঘরে প্রবেশ করলেন। তারপর বিছানায় শায়িত নূরবানুকে টেনে হিঁচড়ে বসিয়ে দিলেন। আম্মি ঘনঘন শ্বাস ফেলতে ফেলতে নূরবানুর দিকে আগুন চোখে তাকিয়ে বললেন, “বল হতচ্ছাড়ি কুকুরী, কোন শুয়োরের বাচ্চা এসব করেছে? এখনিই সেই শয়তানের নাম বল, নইলে তোর পিঠের  চামড়া তুলে নুন মাখিয়ে রোদে ফেলে রাখবো, লোকে দেখবে আর তোর মুখে থুতু দেবে। লাথি মারবে তোর পেটে।”

নূরবানু চুপ করে রইলো। এমনকি তার মধ্যে কোন ভাবান্তরও লক্ষ্য করা গেলো না। আম্মি একাই মুখে যা নয় তা বলে চললেন। তাতে নূরবানুর ভাবখানা এমন যেন সে কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। আম্মি আরও খেপে গেলেন। নূরবানুর  সামনের চুল খামচে ধরে সজোরে তার দুই গালে চড় মারতে লাগলেন। প্রচন্ড ক্রোধে ছোটলোকের ভাষাগুলো তাঁর মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসতে লাগলো, “বল খানকি, কোন হারামির পোনা এই সর্বনাশ করেছে?  নাম বল, নাম বল শীগগিরি। নইলে তোর আজ বাঁচোয়া নাই।” কিন্তু নূরবানু যেন পাথরের মূর্তি, কোন কথাই তার কানে সিঁধোচ্ছে না। অথবা সে শুনেও যেন শুনছে না।

দু’একদিনের মধ্যেই আম্মি ও হাজিরণ কৌশল বদল করলেন। হাজিরণ কাকুতি-মিনতি করে তার মুখ থেকে নামটা বের করার দায়িত্ব নিলো। অন্যদিকে আম্মি নরমেগরমে তাকে বাগে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকলেন। কিন্তু কোন কিছুতেই কাজ হলো না, নূরবানুর ঠোঁট থেকে টুঁ শব্দটিও বেরিয়ে এলো  না।

আম্মি তখন তাদের পারিবারিক ধাই হামিদার কাছ হাজিরণকে পাঠালেন। হামিদা ধাই খুবই বিশ্বস্ত এবং এসব কাজে যথেষ্ট সিদ্ধহস্ত। সে এসে নূরবানুর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে অভয় দিলো, “ছোটি হুজুরাইন, একদম নিশ্চিন্তে থাকো। কোন ভয় নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

হামিদা নূরবানুর কামিজটা একটু তুলে  তার পেটে হাত  দেওয়ার চেষ্টা করতেই এক ঝটকায় তার হাত দূরে সরিয়ে দিলো সে।

“বেটি বললাম তো, এসব এখন একদম ডালভাত, ঘরে ঘরে আকছার ঘটছে এসব জিনিস। কত লোকের বহুবেটি এসব করাচ্ছে নাম বললে এক ফিরিস্তি হয়ে যাবে।” বলতে বলতে হামিদা ধাই আবার নূরবানুর পেটে হাত রেখে পরীক্ষার চেষ্টা করতেই নূরবানু বাঘিনীর মতো গর্জিয়ে উঠলো, “খবরদার! আমাকে একদম স্পর্শ করার চেষ্টা করবে না বলে দিচ্ছি। তোমার টুঁটি টিপে মেরে রেখে দেবো, কেউ টেরও পাবে না।”

নূরবানুর চোখের তারা দুটি হিংস্র আক্রোশে ঘুরতে থাকে, হামিদা ভয়  পেয়ে যায়। সে তৎক্ষণাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে বড় হুজুরাইন ফাতিমাকে হাত জোড় করে বলে, “ আমাকে মাফ করবেন বিবিসাহেবা, এসব জিনের কারবার। আমার সাধ্যের বাইরে।”

আম্মি এবার সত্যিই অথৈ পাথারে পড়লেন। নূরবানুর হাবভাবও দিনদিন বদলাতে লাগলো। সে পবিত্র গ্রন্থ এতো জোরে জোরে পাঠ করে যে অন্তরে কাঁপন ধরে যায়। তার শরীর থেকে অসুস্থতার সব লক্ষণ একে একে দূরে সরে যায়। আম্মির এবার হামিদা ধাইয়ের উপর বিশ্বাস আসে, হয়তো কোন বেহুদা জিনই আশ্রয় নিয়েছে তার বেটির কাছে। “আহা! তার ফুলের মতই মেয়ের এ কি হলো!”  ক’ফোঁটা অশ্রু টপটপ করে ঝরে পড়লো  আম্মির চোখ থেকে।

আম্মির এখন একটাই চিন্তা, যখন ব্যাপারটা আরও জানাজানি হবে, তখন তার স্বামী সাইন ওয়াদি এবং তাঁর পুত্রদের কানে ব্যাপারটা ঠিকই পৌঁছিয়ে যাবে, কিছুতেই চাপা থাকবে না।  আর তার ফলে হতভাগিনী মেয়েটার তকদিরে যে কী দুর্যোগ নেমে আসবে ভাবতে গিয়ে যন্ত্রণায় মুষড়ে পড়লেন আম্মি। এর শেষ পরিণতি যে কতো ভয়ঙ্কর মনে হতেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি।

নূরবানুর রূপের জৌলুস যেন দিনদিন বাড়তে লাগলো। তার খাবারের রুচি আবার ফিরে এলো। সবসময় একটা খুশি খুশি ভাবও তার মধ্যে দেখা গেলো। প্রায়ই দেখা যায় যে, সে আপন মনে গুনগুন করে গান করছে। কোন দুশ্চিন্তাই  যেন তার কাছ ঘেঁষতে পারছে না।

এসব দেখেশুনে আম্মির পাগলের মতো অবস্থা হতে লাগলো। তিনি মনে মনে শুধু বলে চললেন , “হে খোদা, বেটির মৃত্যুর আগে আমার মৃত্যু দাও মালিক। তার বিরহ-ব্যথা  সহ্য করার শক্তি আমার যে  নাই তা তোমার চেয়ে ভালো আর কে বুঝে প্রভু।”

হাজিরণ এখন সবসময়ই নূরবানুর ঘরের পাহারায় থাকে। বাইরে থেকে মাঝে মাঝে লোকজন অবশ্য এখনও আসে। তাদের বলে দেওয়া হয়, আপাততঃ রুগী দেখার কাজটা নূরবানু  বন্ধ রেখেছে জরুরী কারণে। তবে সময় হলে আবার জানিয়ে দেয়া হবে। তখন তারা আবার আসতে পারবে। নূরবানু তাদের সব সমস্যার সমাধান করে দেবে। তাদের জন্য দোয়া করা, তাবিজ লেখা সব কিছুই তখন করে দেবে নূরবানু। মেয়েরা হতাশ হয়ে ফিরে যায়। তবে আশায় বুক বাঁধে শীঘ্রই তারা আবার নূরবানুর সাক্ষাৎ পাবে। তারা ধরে নেয় নূরবানু আধ্যাত্মিক সাধনায় ব্যস্ত আছে এখন, মুরাকাবা-মুশহাদায় কাটছে তার দিন।

এখন  সব কাজটাই নূরবানুর হয়ে সাবধানতার সঙ্গে  করে হাজিরণ। সে সবসময় লক্ষ্য রাখে, যাতে আত্মীয়স্বজন, এমনকি পরিবারের লোকরাও যেন হুট করে নূরবানু ঘরে ঢোকার সুযোগ না পায়। তাদেরও বলে দেওয়া হয় নূরবানু মনে মনে পবিত্র কিতাব পড়ছে এখন। এইসময় তাকে বিরক্ত করা কারও উচিত কাজ হবে না।

তবে আজকাল নূরবানু যখন পবিত্র কিতাব পাঠ করে তখন তার গলার স্বরটা অন্য রকম লাগে সবার কাছে। যেন একটি নিজস্ব ছন্দ ও স্বরক্ষেপ আবিষ্কার করে ফেলেছে সে। আম্মিও তার পবিত্র গ্রন্থের পাঠ শুনেন। অর্থ বুঝেন না হয়তো, কিন্তু পরিষ্কার বুঝতে পারেন তার পড়ার সঙ্গে যে বিষণ্ণতা বিপন্নতা ও আত্মভেদী হাহাকার  মিশে থাকে তা সচরাচর কারও সঙ্গে মিলে না। আম্মি যেন একটু একটু করে উপলব্ধি করছেন  কন্যার বুকের জ্বালা।

কিন্তু আম্মি এতোদিন ধরে যে ভয়টা খাচ্ছিলেন, শেষ পর্যন্ত সেটাই সত্যে পরিণত হলো। তাঁর স্বামী সাইন ওয়াদি ও তাঁদের দুই পুত্র একদিন একসঙ্গে হাজির হলেন নূরবানুকে দেখতে। তিনি সরাসরি স্ত্রী ফাতিমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “নূরবানু কী করছে? বহুদিন তাকে দেখিনি, বাইরে ছিলাম, খোঁজও পাই নি। তাই দেখতে এলাম। রহমত আলি আমাকে বললো, তার স্ত্রী ছোট বাচ্চা নিয়ে নূরবানুর কাছ দোয়া চাইতে এসেছিলো, কিন্তু হাজিরণ নাকি তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে, একটি বারও কথা বলার সুযোগ করে দেয় নি। কী হয়েছে নূরবানুর? সে কি সত্যিই এতোটা অসুস্থ! কই আমাকে খবর দাও নি তো?” স্বামীর মুখে এইরকম নানা প্রশ্ন শুনে আম্মি  বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন।

কিছুক্ষণের মধ্যেই অবশ্য তাঁর চেতনা ফিরে এলো, “না, না, কে বলেছে সে অসুস্থ? সে তো একদম ঠিক আছে। একদম ঠিক।”

স্ত্রীর কথায় সাইন ওয়াদি অবশ্য বিশ্বাস করলেন না। দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, “কেন লুকাচ্ছ তার অসুস্থতার খবর? আমি জানি সে একদম ঠিক নেই।”

বড় ছেলে কাদির বললো, “আম্মিজান, আপনি তো জানেন আমরা, পুরুষ মানুষেরা আমাদের বিষয়-আশয়, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি কত কী নিয়ে ব্যস্ত থাকি, অন্দরের খবর নেওয়ার সবসময় সময় পাইনা।”

ছোট ছেলে নাদির আম্মির কাছে জানতে চাইলো, “আচ্ছা আম্মিজান, নূরবানুআপা এইভাবে পাক কিতাব তেলোয়াত করছে কেন? ওটা তো  তেলোয়াতের সঠিক পদ্ধতি নয়। অথচ তাকে আপনারা ক্বারী রেখে হিবজ করিয়েছিলেন।”

নূরবানু পবিত্র কোরআন পাঠের সঙ্গে কিছুটা কান্নার সুর মিশিয়েছিলো। তার পড়ার সময় মনে হতো যেন কোন হরিণী গভীর জঙ্গলের মধ্যে পথ হারিয়ে ফেলেছে, পরিত্রাণের জন্য কারও সাহায্য চাইছে। ভয়ংকর ভয়ার্ত সব শব্দ তার কণ্ঠ চিরে বেরিয়ে আসছে অশরীরী কোন ডানায় ভর করে তীব্র আর্তনাদ হয়ে। তার ঘর থেকে সেই সব শব্দ গর্জনরত সমুদ্রের শুভ্র ফেনারাশির মতো আছাড়ি বিছাড়ি করে ছড়িয়ে পড়ছে গোটা হাভেলিতে।

কাদিরও ছোট ভাইয়ের সঙ্গে একমত হয়ে বললো, “হ্যাঁ, আম্মিজান, এভাবে তো কেউ কোরআন শরীফ তেলোয়াত করে না। যে আদবের সঙ্গে পাক কিতাব পাঠ করা হয়ে থাকে নূরবানুর পড়ার মধ্যে তার লেশমাত্র আভাস নাই। আদবের বরখেলাপি হচ্ছে। ওকে আপনার বুঝানো উচিত।”

“ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি মানছি ও এখন যে কোন কারণেই হোক মানসিকভাবে কিছুটা অসুস্থ। তাই বলে তোমাদের এতো উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো কোন কারণ ঘটেনি। সময় দাও, সব ঠিক হয়ে যাবে।” সমবেত আক্রমণের মুখে এইভাবে একটি প্রতিরোধের ক্ষীণ চেষ্টা করলেন আম্মি।

সাইন ওয়াদি বললেন, “আমরা ভিতরে গিয়ে নূরবানুর শরীরের অবস্থা একবার স্বচক্ষে দেখতে চাই। তুমি তাকে দরজা খুলে দিতে বলো ফাতিমা।”

বললেন বটে, কিন্তু স্ত্রীর জন্য অপেক্ষা না করে নিজেই দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে হাঁক পাড়লেন, “নূরবানু দরজা খোলো বেটি।” আম্মি তীব্র গতিতে ছুটে এসে তাঁর সামনে দীপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে বললেন, “আমি তো বলছি সব ব্যাপারটা আমার উপর ছেড়ে দাও। অহেতুক তাকে বিরক্ত করো না। তার শরীর ভালো নেই।  এখন তো  আবার তার  ঘুমের সময় হয়ে আসছে।”

“কি বলছেন আম্মিজান, আমি আমার অপার জন্য কালো আঙুর নিয়ে এসেছি সে ভালোবাসে বলে। তার শরীর খারাপ হলে এসব খাওয়া তার খুব দরকার।” নাদির আম্মির উদ্দেশ্যে কথাগুলো বললো। আম্মি তাকে বললেন, “ফলটল তার ঘরে গাদা আছে। ওসব না হলেও তার চলবে।”

সাইন ওয়াদি হাত দিয়ে বেগমকে একটু সরিয়ে দিয়ে দরজায় ধাক্কা দিতে গেলে ফাতিমা চিৎকার করে বলে উঠলেন, “খবরদার, দরজায় ধাক্কা দিয়ে হাভেলির লোক জড়ো করবে না বলছি। দাঁড়াও, আমি তাকে ডাকছি। সে নিজেই দরজা খুলে দেবে।”

কিন্তু আম্মিকে কিছু বলতে হলো না। নূরবানু সহসা ধড়াম করে দরজার কপাট খুলে রুদ্রমূর্তিতে  তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো। নূরবানুর এই মূর্তি দেখে সবাই তাজ্জব হয়ে গেলো। এ কি সত্যিই তাদের সেই নূরবানু! মোমের পুতুলের মতো নরম ও কোমল স্বভাবের তাদের আদরের নূরবানু!

একটা গভীর নিঃশব্দ নিস্তব্ধতার মধ্যে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণের জন্য সম্বিত হারিয়ে ফেললো সবাই। কিন্তু বেশিক্ষণের জন্য নয়। সবাই বিস্মিত হয়ে দেখলো তাদের সামনে বেহায়া নির্লজ্জের মতো বুক উঁচিয়ে, মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে যে মেয়েটি  অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে সে কি সত্যিই নূরবানু, না অন্য কেউ! মাথায় উড়না নাই, গায়ে একটা চাদরও  নাই, পাতলা সুতোর কামিজ পরা যে মেয়েটি পেটটা উঁচু করে তাদের দেখাচ্ছে, সে কে?”

আম্মি ছুটে গিয়ে একটা মোটা চাদরে মেয়ের সর্বাঙ্গ ঢেকে দিয়ে আব্রু রক্ষার একটা শেষ মরীয়া চেষ্টা করলেন। কিন্তু নূরবানু সঙ্গে সঙ্গে চাদরটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এক চূড়ান্ত যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে তখন। আম্মি দুই হাতে চোখ ঢেকে কেঁদে উঠলেন।

কাদির চিৎকার করে উঠলো, “বেহায়া বেশরম নির্লজ্জ কুকুরী, এখনও আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছিস তুই?”

“নূরবানু , শীঘ্রই বল কোন হারামির বাচ্চা তোর এই অবস্থা করেছে, আমি তাকে টুকরো টুকরো করে কেটে ডালকুত্তা দিয়ে খাওয়াবো।” সাইন ওয়াদির গর্জনে গোটা হাভেলি যেন কেঁপে উঠলো।

নাদির নূরবানুর জন্য আনা কালো আঙ্গুরের প্যাকেটটা তার গায়ের উপর ছুঁড়ে দিয়ে উত্তেজনায় হাঁপাতে লাগলো। স্থান-কাল-সম্পর্ক ভুলে কাদির উন্মত্তর মতো আবার চেঁচিয়ে উঠলো, “তোর পেটের মধ্যে যে জারজ-হারামি বড় হচ্ছে, দেখ কেমন করে তাকে নিকেশ করে দিই!”

এতক্ষণ নূরবানু একটাও কথাও বলেনি। সমবেত আক্রমণের মুখে অটল সাহস নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আপনজনদের উন্মত্ততা দেখছিলো শুধু। কিন্তু তার পেটের বাচ্চাকে ‘জারজ-হারামি’ বলার সঙ্গে সঙ্গে  ক্রুদ্ধ বাঘিনীর মতো হুঙ্কার ছেড়ে সে বললো, “জারজ-হারামি! কাকে বলছো এ কথা? এ আমার বাচ্চা, আমার আদরের ধন, সাত জন্মের হারানো মানিক। একে জারজ বলে কার এতো বুকের পাটা!”

সাইন ওয়াদি এবার গর্জিয়ে উঠে,”হারামি ছাড়া ওর অন্য কোন পরিচয় নাই, জানিস না তুই?”

“কার সঙ্গে আমাকে দেখছো তোমরা যে আমার পেটের বাচ্চাকে জারজ-হারামি বলছো? লজ্জা করে না তোমাদের?”

নূরবানু তার ভরা পেট নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে গোটা ঘর। সে আঙ্গুল তুলে তাদের সঙ্গে কথা বলছে। “আমার পেটে বাচ্চা এসেছে, আসতেই পারে, কী দোষ এতে, স্বাভাবিক নিয়ম তো এটাই।”

সাইন ওয়াদি এবার নিজের কানকেই আর বিশ্বাস করতে পারছেন না। “কি সব বলছে ও? ও কি সত্যিই উন্মাদ হয়ে গিয়েছে ?”

বড় ভাই কাদির চরম কিছু করার সংকল্প নিয়ে নূরবানূর দিকে আগিয়ে যেতে যেতে বিদ্রূপ করে বলে, “স্বাভাবিক, দোষ নেই! …….তোর বিয়ে হয়েছে, বেশরম বেশ্যা?”

স্বামী ও দুই পুত্রের রণংদেহী মূর্তি দেখে ভয়ে আম্মির অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে। তিনি বেশ বুঝতে পারেন একটা চরম কিছু ঘটতে যাচ্ছে এখনিই। তিনি হাত জোড় করে স্বামী সাইন ওয়াদির সামনে দাঁড়ালেন। স্বামী এক ঝটকায় তাকে দূরে সরিয়ে দিলেন। তিনি প্রায় মূর্ছিত হয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন, তার আগেই মেয়ের দিকে তার চোখ পড়লো। তিনি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলেন মেয়ের চোখেমুখে তিলমাত্র ভয়ের চিহ্ন নাই। সে যেন তার পিতা ও ভাইদের সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত।

“বিয়ের কথা তুলছো তোমরা? আমার স্বামী কে আজ এতোদিন পরে আমার কাছে তার কৈফিয়ত নিতে এসেছো? কেন দেড় বছর আগে অমন ঘটা করে আমার বিয়ে দিলে তোমরা, সে কথাটা কি বেমালুম ভুলে গিয়েছো? দামী গয়না-শাড়িতে আমাকে বধূবেশে যখন ঘন্টার পর ঘন্টা এই ঘরে বসিয়ে রেখে আমোদ-ফুর্তিতে মাতোয়ারা হয়ে মাথায় ফেট্টি বেঁধে বাজনার তালে তালে ঢোল পিটিয়ে নাচছিলে তোমরা, সেটা কার বিয়ের অনুষ্ঠান ছিলো? সমস্ত আত্মীয়স্বজন, লোককুটুম্বদের এনে এলাহী খানাপিনার আয়োজন করে হাজার হাজার টাকা উড়িয়ে আভিজাত্য দেখিয়েছিলে সেটা কার বিয়ের অনুষ্ঠান ছিলো? মিরাজি দলের মেয়েরা নেচে নেচে তোমাদের কনের পিতা, কনের ভ্রাতা বলে সম্ভাষণ করে একের পর এক আব্দার করে যাচ্ছিলো আর তোমরা থলে থেকে তঙ্কা বের করে তাদের খায়েশ মিটাচ্ছিলে, সেটা কার বিয়ের অনুষ্ঠান ছিলো? “

কাদির রাগে গরগর করতে করতে দাঁতে দাঁত ঘষে তাকে ধমকিয়ে থামিয়ে দিতে চাইলো, “খামোশ! …কে তোর স্বামী? কার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে তোর? তোর পেটের  বাচ্চাটা জারজ-হারামি ছাড়া আর কি?”

“কার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে? কে আমার স্বামী? তোমরা কিছুই জানো না , না?” বলতে বলতে  নূরবানু ডানদিকে সরে গিয়ে সুদৃশ্য বাক্সের উপর মণিমাণিক্যখচিত মেহগনি কাঠের রেহেলের উপর দামী রেশমী যুবদানিতে আবৃত পবিত্র কেতাব কোরআন শরীফটি পেড়ে এনে সবাইকে দেখিয়ে বললো, “এই দেখো, এই আমার  স্বামী , এই পবিত্র গ্রন্থের সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়েছিলে তোমরা।”

“নির্লজ্জ, বেশরম, বাচাল মেয়ে এতো স্পর্ধা তোর”–রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে সাইন ওয়াদি চিরতরে এই পাপিষ্ঠাকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে এগিয়ে আসেন  নূরবানুর দিকে। তাঁর দুই পুত্রও একই সঙ্গে সমান আক্রোশে নূরবানূর দিকে ধাবিত হতে থাকে কুকুরপেটা করে তাকে পিটিয়ে মারার জন্য।

আম্মি চোখ বন্ধ করে। গোটা বিশ্ব-ব্রহ্মান্ড ঘুরতে থাকে তার চোখের সামনে। রোজ কেয়ামতের আভা নেমে আসে, সুর্য সাত তবক আসমান ভেদ করে মাথার উপর মাত্র দেড় হাত দূরে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে।

“দাঁড়াও, আর এক পাও এগুবে না”–নূরবানুর কণ্ঠে যেন আকাশ-গর্জন। সে এবার পাক কিতাব কোরআন শরীফকে পেটের উপর চেপে ধরে বলে, “আমার বাচ্চার ক্ষতি করতে এলে এই পবিত্র গ্রন্থই তার মোকাবিলা করবে। …শুনছো, শুনছো তোমারা, এই পবিত্র গ্রন্থের বাচ্চা আমার পেটে। এসো ,…কে আসবে  এসো। সাহস থাকে তো আমার স্বামীকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নাও।”..

পবিত্র কালাম তখন নূরবানুর পেটের শিশুটিকে রক্ষা করার জন্য বর্মের মতো তার পেটে সেঁটে থাকে। নূরবানুর চোখ থেকে যেন হাবিয়া দোজখের আগুন দাউ দাউ জ্বলতে থাকে।

তিনজন পুরুষ লাজবাব হয়ে তখন প্রস্তরবৎ  দাঁড়িয়ে। কোন অদৃশ্য শক্তি যেন তাদের চলৎশক্তিকে রহিত করে দিয়েছে, বাকশক্তি কেড়ে নিয়েছে।

“এসো , সাহস থাকে তো এগিয়ে এসো, ছিনিয়ে নাও আমার স্বামীকে আমার কাছ থেকে।”

নূরবানুর আহ্বান  কারও কানে পৌঁছোয় না। সবাই যেন মূক ও বধির,পটে আঁকা স্থিরচিত্র।

 

                             শব্দার্থ

খুশনসিব–সৌভাগ্য।     তোওফা–উপহার।  কদমবুসি–পদ-চুম্বন।           সিজদা–আভূমি প্রণতি। নামাজের একটি বিশেষ রীতি।

মোনাজাত–প্রাথর্না। শামস–সূর্য ।   মিরাজওয়ালি–নাচ-গানসহ বিয়ের গীত গাওয়া মহিলা দল।   খোশআমেদ–অভিনন্দন।    সাবুদ–প্রমাণ।   দুলহা–পাত্র।

নিকাহনামা–বিয়ের চুক্তিপত্র।  যুবদানি –পবিত্র গ্রন্থ ঢাকার জন্য আবরণ।

তেলোয়াত–পাঠ করা।   বেফজুল–অনর্থক। বুলন্দ–প্রশস্ত।   বদনা–এক ধরণের গাড়ু যা কেবল মুসলমানরাই ব্যবহার করে। ছেলেপচি–মুখ-হাত ধোয়ার পাত্র।  সৈয়দানি–উচ্চবংশ-সম্ভুতা নারী।  জায়নামাজ–নামাজ পড়ার আসন।

মাসুম–নির্দোষ।  মাবুদ–প্রভূ, উপাস্য।  কিয়ামত–বিচার দিবস।  তেলেসমাতি–ভোজবাজী।  কুদরতি–বিস্ময়কর শক্তি।  চবুতরা–প্রাঙ্গন।   ক্বারী–যে হাফেজ শুদ্ধ উচ্চারণের সঙ্গে সুরেলা কণ্ঠে পবিত্র কোরআন শরীফ পাঠ করতে পারেন।

হিবজ–মুখস্ত করা।  বরখেলাপি–কথা দিয়ে কথা না রাখা।। রেহেল–কাঠ বা ধাতু নির্মিত বস্তু যার উপর সাধারণতঃ পবিত্র কোরআন শরীফ রেখে পাঠ করা হয়। হাবিয়া দোজখ–সবচেয়ে ভয়ঙ্কর নরক।

 

অনুবাদক পরিচিতি :  বদরুদ্দোজা হারুন মূলতঃ একজন গবেষণাধর্মী লেখক হিসাবে আন্তর্জাতিক বাঙালি সমাজে পরিচিত। তিনি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের ডব্লু বি সি এস (এক্সি) ক্যাডারের উচ্চপদস্থ আধিকারিক হিসেবে অবসর নেওয়ার পর লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। তাঁর কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ এবং ফিচারধর্মী লেখা দুই বাংলাসহ আসাম, ত্রিপুরা, ঝাড়খণ্ড ও পৃথিবীর নানা প্রান্তে অবস্থিত পত্র -পত্রিকার মাধ্যমে সুধী সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। একজন চিত্রশিল্পী যেমন শুধু পেন্সিলের ডগায় নান্দনিক শিল্পসুষমার জন্ম দিতে পারেন, তিনিও তেমণি বাস্তব–পরাবাস্তবের সৌন্দর্যশৈলীতে অনায়াসে অনন্য সব কবিতার জন্ম দিতে পারেন। নাগরিক যন্ত্রণাকে উপেক্ষা করে তন্নিষ্ঠ তন্ময়তায় তিনি সহজেই পৌঁছে দেন পাঠককুলকে সৃষ্টির রসঘন মেদুরতায়। অনুবাদ গল্পকেও তিনি সৃষ্টি করেন তাঁর নিজস্ব স্টাইলে, শব্দবন্ধ ও ভাষা -চাতুর্যে, যা অভিনব ও অনুপম। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা বারো।

 

 

Leave a comment

Check Also

দর্পণে

দর্পণে – নির্মাল্য ঘরামী    

    -চল, আমি জোরের সঙ্গে বললাম, -ওসব একদম ভাবিস না। তোকে এতদিন পরে পাচ্ছি, …

ফয়সালা

ফয়সালা – নির্মাল্য ঘরামী

  -দেখুন স্যার। বলে সিকিউরিটি গার্ডটি বিজয়ীর দৃষ্টিতে মহাকুলসাহেবের দিকে তাকালো। তার হাতে ধরা ব্যাগটির …

রক্তগোলাপ/ মৌসুমী পাত্র/ পুণ্যতোয়া ধর

রক্তগোলাপ – মৌসুমী পাত্র

  একটা মোটা দড়ি থেকে পাশাপাশি ঝোলানো সারি সারি মৃতদেহ। ছাল ছাড়ানো। গত কদিন ধরেই …

যখন অন্ধকার হাতছানি দিল

যখন অন্ধকার হাতছানি দিল – নির্মাল্য ঘরামী

  আলোটা এবারে দপ করে নিভে গেল। -যাহ! ওর মুখ দিয়ে শব্দটা প্রতিবর্তক্রিয়ার মতন-ই বেরিয়ে …