Home / গল্প / অদ্ভুতুড়ে : মিথ্যে ভূতের সত্যি গল্প – নবকুমার দাস

অদ্ভুতুড়ে : মিথ্যে ভূতের সত্যি গল্প – নবকুমার দাস

ভূতের গল্প/ নবকুমার দাস
শিল্পী- পুণ্যতোয়া

 

ভূতের গল্প শুনতে কার না ভালো লাগে ?

অবশ্য ভূতের পাল্লায় পড়তে নিশ্চয়ই কেউ চায় না। সেই ছোট বেলা থেকে নানা রকম ভূতের গল্প শুনলেও কখনো ভূতের দেখা পাইনি তাই মনে মনে একটা আফসোস আছে । গ্রামাঞ্চলে ভূত, দত্যি, দানো সম্পর্কে বাচ্চা ছেলেরাও জানে। পেঁচোয় পাওয়া, বোবায় ধরা, নিশির ডাক, ভুলোয় ভুলানো ইত্যাদির পাশাপাশি শাঁকচুন্নি, মামদো, ব্রহ্মদত্যি, স্কন্ধকাটা ইত্যাদি নানান দিশি ভুতের ফন্দিফিকির সম্পর্কে সেই কচি বয়স থেকেই আমরা অনেক কথা জানি যা আজকালকার ছেলেমেয়েরা তুলনামূলকভাবে কম জানে। অবশ্য তারা এখন যা জানে সেসব বিষয়ে আমরা তখন জানতাম না হয়ত। যেখানে যত বেশি অন্ধকার সেখানে ততবেশি ভূতের জমজমাট বাজার-হাট, ঘর-বসত।

আমার দুই দাদু মানে মায়ের বাবা ও কাকা বা দাদামশাই ছিলেন অলিখিত ভূতের গল্পের অফুরান ভান্ডার। ঠাকুরদা আমার খুব ছোটবেলায় মারা গেছেন তাই এই দুই দাদামশাই বা দাদুর কাছে আমাদের আবদার ছিল অনেক বেশি। ঘটনাক্রমে ঘোর বর্ষায় কিংবা হাড় কাঁপানো শীতে আমরা তুতো ভাইবোনেরা বড় দাদু কিংবা ছোট দাদুর মধ্যে কোন একজনকে ঘিরে ধরে গোল হয়ে বসে সেই সব উত্তেজনাময় ও লোমহর্ষক গল্প শুনতাম। বেশ কয়েক বছর পরে ছোড়দাদু ডাকাতের ছোঁড়া বোমায় মারা যান তাই দীর্ঘদিন ধরে বড়দাদুই ছিলেন আমাদের প্রিয় ও একমাত্র গল্পবলিয়ে মজাদার মানুষ। তাঁর জীবন ছিল বিচিত্র অনেকটা রায়মশাইয়ের তারিণীখুড়োর মত। প্রথমদিকে চকমকি পাথর ও পরের দিকে পেট্রলের লাইটার দিয়ে নিজের তৈরী কিংসাইজ বিড়ি কিংবা ক্যাপস্টান সিগারেট ধরিয়ে ছোটছোট সুখটান দিয়ে গল্পবলা শুরু করতেন। লম্বা গোঁফওয়ালা ও দীর্ঘ চেহারা ও উজ্জ্বল চোখের দাদুর কাছে মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান, বীরভূম ও নদিয়া জেলার নানান গ্রামগঞ্জ ও তল্লাটের অদ্ভুত গল্পের ভান্ডার ছিল। তিনি সেইসব গল্পের ঝুলি উজাড় করে দিতেন। তবে শর্ত ছিল একটাই- একবারে একটি মাত্র গল্প। এক আসরে বড়দাদু দুটো গল্প বলতেন না। অবশ্য আমরা সেই একখানি করে গল্প শুনেই কাৎ হয়ে যেতাম।

বিদেশী বা সাহেব মেম ভূত সম্পর্কে বরং জেনেছি ভূতের গল্পের বই পড়ে। আমাদের পল্লীমঙ্গল পাঠাগারে ক্ষুদে ও ধেড়ে পড়ুয়াদের মধ্যে ভূতের গল্পের দারুণ চাহিদা ছিল সেই সময়। আমি অবশ্য সেই বয়সেই পড়ছি ‘ভাগো ভূত ভগবান’। স্বাভাবিকভাবেই ভূত সম্পর্কে আমার অদ্ভুত রকমের নিস্পৃহতা তৈরী হয়ে যাচ্ছিল। তখনি আমার মধ্যে ভূতের ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়েছিল। তবে স্বীকার করি রাত জেগে ভূতের গল্প পড়া কিংবা ভৌতিক সিনেমা দেখার মজা আলাদা। সেই সব অনুভবগুলো বেশ লাগে। রোমাঞ্চকর ও গা ছমছমে অভিজ্ঞতা আমাদের গ্রামীণ কিংবা নাগরিক জীবনের একঘেয়েমি কাটিয়ে দেয় বৈকি !

তবে আজ বেশ কয়েকটি ভূতুড়ে গল্পের কথা মনে পড়ছে যা কিনা বাস্তবে ঘটেছে বলে দাবি করা হয়। প্রথম গল্পটি এক মেছো ভূতের। প্রথম শুনেছিলাম ছোটদাদুর কাছে। অবশ্য পরে বড়দাদুও সেই কাহিনীটিকে আবারো বলেন এবং আমরা নিশ্চিত হই যে এমন ঘটনা সত্যিই ঘটেছিল। প্রথমেই বলে রাখি এই গল্পের সময় কাল প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের,পটভূমি কলকাতা শহর থেকে প্রায় দুশো কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে বর্তমানের পূর্ব বর্ধমান ও বীরভূমের সীমান্ত সংলগ্ন মুর্শিদাবাদ জেলার দুটি গ্রাম। কাহিনীর স্বার্থে গ্রামগুলি ও কুশীলবদের নাম ঈষৎ বদলে দিচ্ছি।

গ্রামের নাম কুঁদুলে। ঠিক এর পাশের গ্রামের নাম ধুঁধুলে। মাঝখান দিয়ে চলে গিয়েছে ময়ূরাক্ষীর ব্রাঞ্চখাল। সবাই এই খালটাকে ক্যানেল বলে। মুখ্যুসুখ্যু গেঁয়ো মানুষেরা বলে ক্যালেন । শুখা মরশুমে কখনো সখনো সেই ক্যানেলে জল আসে তবে ভরা বর্ষায় চাষিদের যখন আর জলের দরকার থাকেনা তখন এই ক্যানেলে গহীন জল থাকে এবং সেই জল তিলপাড়া ব্যারেজের জল নাকি শালিন্দা বিলের জল তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও থাকতে পারে তবে ক্যানেলের ধার ঘেঁষে গরু-মোষের গাড়ি চলাচলের রাস্তাটিই যে এই কুঁদুলে গ্রামের সঙ্গে বাইরের গ্রাম বা দুনিয়ার সংযোগের অন্যতম পথ তা নিয়ে কোন বিতর্ক নেই। অনেকে বলেন যে এই গ্রামের এইরকম বিশ্রী ও অনিশ্চিত রাস্তাঘাটের কারণে এই গ্রামের ছেলে মেয়েদের দূরের গ্রামে খুব একটা বিয়ে-থা হয়না । বিয়ে-থা নিজেদের গ্রামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে । দুয়েকজনের সম্পর্ক কাছাকাছি গ্রামে। অবশ্য এই কুঁদুলে গ্রামে শিবতলা, সেনপাড়া, গোয়ালপাড়া ইত্যাদি গ্রাম থেকে অন্য একটি মেঠো রাস্তা দিয়ে যাওয়া আসা করা যায়, তবে তা শুধুমাত্র পায়ে হেঁটে, চাষের জমির আলপথ ধরে।

কুঁদুলে গ্রামের লোকেদের বেশিরভাগই চাষিবাসী মানুষ। চাষবাস করে ফসল ফলানো, সেই থেকেই সারা বছরের খাওয়া দাওয়ার, জীবন যাপন। গোলা ভরা ধান, মাঠ ভর্তি গম, আলু, ডাল-কলাই, শাক-সবজি,পুকুর ভর্তি মাছ, বাগান ভর্তি ফলফলাদি তাই কেউ তাদের জমির এক ছটাক ছাড়তে নারাজ। রাস্তা তো আর আকাশে তৈরী হবে না কিন্তু এই জমি নিয়ে সবাই ঝগড়াঝাটি আর কোন্দলে ব্যস্ত। তাই এই গ্রামে কোন ছোট,বড়, মেজো,সেজো, ন, ফুল কোনো রাস্তাই তৈরী হয়নি। গ্রামের গরিবগুর্বো কাজের লোকেরা ইচ্ছা করলেও ভিনগাঁয়ে গিয়ে কাজ করে দিনের দিন ফিরে আসতে পারেনা। গ্রামেই কম টাকায় খাটতে বাধ্য হয়। এইসব নানা কারণে গ্রামের পুরানো নাম কুণ্ডলিনী থেকে লোকমুখে কুঁদুলে হয়েছে। পাশাপাশি গ্রামের লোকেরা এদের হাল দেখে হাসে। বিশেষ করে ধুঁধুলে গ্রামের লোকেরা। সেখানে তো সদর থেকে ভটভটিয়ে মটরগাড়ি নিয়ে আসা যাওয়া করা যায়। পাকারাস্তা , পোস্ট অফিস, হাইস্কুল, ডাক্তারখানা সবই আছে । এখানে কুঁদুলে গ্রামে চাষের ধান গোলায় তোলার সুবিধার জন্যে কিংবা আখের রস থেকে গুড় তৈরি করার মাড়াই বয়ে নিয়ে আসার জন্য শুধুমাত্র গ্রামের ভিতরে গরুর গাড়ি কিংবা মোষের গাড়ি চলাচলের উপযুক্ত একখানি মাত্র মাটির রাস্তা আছে। বলা যায় ফেয়ার ওয়েদার রোড। বর্ষাকালে একহাঁটু কাদা থাকে সেখানে। ভালো রাস্তা তৈরী করার ব্যাপারে চেষ্টা করতে করতে সাবেক ইউনিয়ন বোর্ড থেকে শুরু করে হালের গ্রামপঞ্চায়েতের সদস্যদের অনেকেই মরে ভূত হয়ে গিয়েছে। এমন গ্রাম ভূতের স্বর্গ হবে বৈকি। সন্ধ্যের পর সেখানে নিজের ঘরের দাওয়ার বাইরে যেতে মানুষজন রীতিমতো ভয় পায়।

সে যাই হোক , বর্ষায় ক্যানেলের জল চাষের কাজে তেমনভাবে ব্যবহার না হলেও শাল, শোল, কই, মাগুর, জিওল, চ্যাং ছিঙুরি নিদেন পক্ষে বেলে কিংবা সরপুঁটি ইত্যাদি নানান মাছের উৎস কিংবা আড়ৎ হিসাবে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। এই গ্রামের জেলেরা কিংবা চাষিবাসী পরিবারের কেউ কেউ ক্যানেল থেকে মাঠে জল যাওয়ার সেচ নালায় কিংবা ছোটখালে আড়া পাতে। মাছ ধরার সেই ফাঁদ বা আড়া দেখার মত জিনিস। মাছকে ফাঁদে ফেলার জন্য সারি সারি শরকাঠি পুঁতে একটি হাপা বা ছোট গর্তের দিকে চালনা করা হয়। তারপর খাল দিয়ে জল চলে গেলেও মাছ গিয়ে পড়ে ওই হাপায়, কেউ কেউ এটাকে আপা বলে। গ্রামে মস্ত বড় বাদাপুকুর থেকে শুরু করে ঘষিপুকুর ,পদ্মপুকুর নতুনপুকুর মান্দাপুকুরে বেশ স্বাদু রুই কাতলা, রাঘব বোয়াল থাকলেও বর্ষার মরশুম থেকে শুরু করে প্রায় অঘ্রাণের হালকা শীত পড়ার আগে পর্যন্ত এই সব আড়ায় ধরা পড়া নদী নালার এই সব মাছের স্বাদ অন্যরকম। এই মাছের স্বাদ পাওয়ার জন্যে শুধু মানুষ নয় তেনারাও তক্কে তক্কে থাকেন।

অনেক বছর আগের ঘটনা । ডাক্তার জনার্দন পাল কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাস করে এদিকেরই কোনো গ্রামীণ হাসপাতালে যোগ দিয়েছিলেন। কুঁদুলে গ্রামের আদি বাসিন্দা হলেও ডাক্তারবাবুর বাবা সম্পন্ন চাষী সুধন্য পাল একটু অন্য ধাঁচের মানুষ। এই গ্রামে তাঁরও শ্বশুরবাড়ি। একমাত্র ছেলের পড়াশোনার সুবিধার জন্যে বহরমপুরে গোরাবাজারে বাড়ি তৈরী করেছিলেন। জনার্দন পাল বেশ কয়েক বছর আগে বহরমপুর সদর হাসপাতালে পোস্টিং পেয়েছেন । অতএব এখন সপরিবারে বহরমপুরেই থাকেন তবে গ্রামের উৎসব অনুষ্ঠানে যোগদিতে ও জমিজমার হিসাবপত্তর দেখতে বছরে দুয়েকবার কুঁদুলে গ্রামে আসতে হয় । অঘ্রাণ মাসের মাঝামাঝি। নবান্নের সময় তিনি গ্রামে আসছেন। নতুন ধানের উৎসব নবান্ন, গেঁয়ো লোক বলে লবান। বহরমপুর থেকে এবারে বউ বাচ্চাদের সঙ্গে করে নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি। ছোট ছেলেটি সর্দি কাশিতে একটু ভুগছে তাই এই সময়ে গ্রামে আনা ঠিক হবেনা ভেবে একাই এসেছেন। এবার যেন আগাম শীত পড়েছে এদিকে। ঘটনাক্রমে এই গ্রামেই ডাক্তারবাবুর শ্বশুরবাড়ি। ইচ্ছে একটা রাত্রি শ্বশুরবাড়িতে থেকে পরদিন জমিজমার ব্যাপার স্যাপার আয়ব্যয় দেখে নবান্নের দিনটা নিজের বাড়িতে কাটিয়ে পরেরদিন বহরমপুরে ফিরে যাবেন।

সেরকম ভাবে আগেভাগেই তিনি তার শ্বশুরবাড়িতে চিঠি লিখে জানিয়ে দিয়েছেন। অতএব সব ব্যবস্থা পাকা। তিনি এলেন ঘটনার দিন দুপুরে। জেলা সদর বহরমপুর থেকে নিজেই মোটর চালিয়ে ধুঁধুলে গ্রামে দিদির বাড়ি এসেছেন । দুপুরে খাওয়া দাওয়া ও বিশ্রাম করে পড়ন্ত বিকেলে তিনি কুঁদুলে গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। দু মাইল রাস্তা , এমন কিছু দূর নয়। একসময় এই সব এলাকায় তিনি ঘোড়ায় চড়ে ডাক্তারি করেছেন। রাস্তাঘাট নখদর্পণের মত চেনা। তিনি এখন বাইরে থাকলেও এই এলাকারই মানুষ উপরন্তু কুঁদুলে গ্রামের জামাই। তাই তিনি পরম নিশ্চিন্তে পাকা রাস্তা ছেড়ে কুঁদুলে গ্রামে যাওয়ার জন্যে ক্যানেলের বাঁধের উপরের মেঠো রাস্তা ধরলেন। ক্যানেলের জল কমে এসেছে। রাস্তা বলতে পায়ে হেঁটে যাওয়ার মত সরু শুঁড়ি রাস্তা। দুপাশে ঝোপঝাড়, বাঁশবন, কালকাসুন্দা, আমলকি, মহুয়া, বহুলার ঝোঁপের মধ্যে দিয়ে কোনক্রমে এগিয়ে যাওয়ার মত পথ তবে তা আলপথের থেকে ভালো। মরশুমের ধান কেটে চাষীরা বোঝা বেঁধে এই পথে নিয়ে গিয়েছে। রাস্তায় পড়ে থাকা ধানের শিস আর খড়ের টুকরো দেখে তাই মালুম হচ্ছে। দুই-চারটে গরুর গাড়ি এই পথে গিয়েছে সেটা মাটিতে কাঠের চাকা আর লোহার বেড়ের দাগ দেখে বুঝলেন। এই ভাবে বেশ কিছুটা পথ পেরিয়ে আসার পর তার মনে হল রাস্তা যেন আর শেষ হয়না। মনে মনে ভাবলেন, শহরে থেকে থেকে তাঁর হাঁটার অভ্যেসটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। নইলে এ আর এমন কি রাস্তা! ছোটবেলায় এই রাস্তা দিয়ে হেঁটে গিয়েই কয়েক বছর ধুঁধুলে গ্রামের স্কুলে পড়েছেন। বয়স বাড়ছে বোধ হয়! যাই হোক হাবিজাবি নানান ভাবনা ভাবতে ভাবতে, আরো কিছুটা পথ এগিয়ে গিয়ে পড়ল মাস্টারের কলাবাগান। মাস্টার মানে তার শ্যালক ঘনশ্যাম রায়। পাশের গ্রাম চুনশহরের স্কুল মাস্টার। সোম থেকে শনিবার কাঁধে দোনলা বন্দুক ঝুলিয়ে স্কুলমাস্টারি করতে যায়। তার প্রাণে বড় ভয়। নামে শহর অথচ সাড়ে ষোলোআনা গন্ডগ্রাম চুনশহর নাকি ডাকাতের গাঁ। আসলে দিন দিন ঘনার যত সম্পত্তি বাড়ছে, প্রাণে মরার ভয় বা খুন হয়ে যাওয়ার ভয়ও সমানহারে বাড়ছে।

মাস্টারের কলা বাগান ডানহাতে রেখে এবার বাঁদিকের গরু ছাগল ভেড়া ইত্যাদি গবাদি পশুর যাওয়া-আসার রাস্তা ডহর বা সড়ান ধরে নতুন পুকুর পাড়ে উঠলেই গ্রাম দেখা যাবে। সেখান থেকে একটু এগুলেই গ্রামের রাস্তা। দীনু পালের খামার বাড়ি , গ্রামের ছেলেদের সেটাই ভলিবল খেলার মাঠ। পাশেই বেজা পালের মুদিখানা দোকান।

কিন্তু ক্যানেলটা গ্রাম থেকে কিলোমিটার খানেক দূরে। আসন্ন সন্ধ্যায় হালকা কুয়াশার  হালকা চাদর চারপাশে ঘিরে রেখেছে। একটা ছোট্ট বাচ্চার কান্গ্রানার আওয়াজ পেলেন। গ্রামের দিক থেকে সন্ধ্যারতির আওয়াজ ভেসে আসছে। এমন সময় তিনি দেখলেন একটি বাচ্চা ক্যানেলের রাস্তায় কাঁদছে। তিনি এদিক ওদিক চাইলেন ভাবলেন বোধহয় গ্রামের কোনো বউ ঝি এই সন্ধ্যে বেলায় শৌচ কর্মের জন্যে ক্যানেলের পাড়ে এসেছে। সঙ্গে এই বাচ্চাটাকে নিয়ে এসেছে কিংবা সবার দৃষ্টি এড়িয়ে গ্রাম থেকে বাচ্চাটি এতদূর চলে এসেছে। তিনি একবার হাঁক দিলেন ,”এই, কার বাচ্চা গো ?”

কেউ সাড়া দেয়না। তিনি অস্থির হয়ে পড়লেন। কি রকম কান্ডজ্ঞানহীন লোকজন! একটা বাচ্চা হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াচ্ছে অথচ কারো ভ্রূক্ষেপ নেই কিংবা খোঁজ খবর নেই। আরো বার দুয়েক হাঁক ডাক করলেন। কিন্তু কেউ সাড়াশব্দ করল না দেখে তিনি বাচ্চাটিকে নিজের সঙ্গে করে নিয়ে গ্রামে যাওয়ার কথা ভাবলেন। বাচ্চাটি তাকে দেখে এখন কান্না বন্ধ করে হি হি করে হাসছে। ডাক্তারবাবু বাচ্চাটিকে ভালো করে দেখলেন। বেশ সম্পন্ন বাড়ির বাচ্চা বলেই মনে হচ্ছে। দুই হাতে রুপোর বালা, গলায় সোনার চেন তাতে সাদা চুষিকাঠি ঝুলছে। কোমরে রুপোর বিছে। পোশাক আশাক বেশ দামী। একে উদ্ধার করে গ্রামে নিয়ে গিয়ে খোঁজ খবর করলে নিশ্চয় জানা যাবে কাদের বাড়ির বাচ্চা। যেমন ভাবা তেমন কাজ। বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিলেন।

একটু যেতে না যেতেই তিনি দেখলেন তিনি বাচ্চাটিকে যতটা ছোট ভেবেছিলেন ততটা ছোট নয়। বেশ ভারী লাগছে। বাচ্চাটাকে কোলে করে হাঁটা যাচ্ছে না। কোল থেকে তাকে ঘাড়ে তুলে নিলেন। আরো কিছুটা পথ এগিয়ে গিয়ে দেখেন ঘাড়টা কেমন ভার ভার লাগছে। একটু শান্তির জন্যে বাচ্চাটাকে নামিয়ে পিঠে নিলেন। কী ঝামেলা, একে তো পিঠেও রাখা যাচ্ছে না! উপরন্তু মাটিতে কিছু একটা ঘষটানির আওয়াজ আসছে। তাছাড়া বাচ্চাটার হাতদুটো কেমন মোটা লাগছে তা অনুভব করে পিছন ফিরে দেখার জন্যে ঘাড় ঘোরাতেই তাঁর চক্ষু চড়কগাছ। হাড়হিম ঠান্ডায় তার হাত পা যেন অবশ হয়ে যাচ্ছে। তার পিঠে বেশ আছে এক বিদঘুটে বুড়ো। আগুনের ভাঁটার মত চোখ। একমুখ গোঁফদাড়ির জঙ্গল। এতো সেই বাচ্চাটি নয়! তাছাড়া বাচ্চা ছেলের পা অতো লম্বা হয় কী করে! লম্বা লম্বা পা দুখানি যেন মাঝে মাঝে মাটিতে ঘষা খাচ্ছে আর শক্ত মাটিতে লাঙলের ফলা লাগলে যেমন ধাতব আওয়াজ ওঠে তেমন শব্দ হচ্ছে।

ডাক্তারবাবুর বুঝতে বাকি রইল না তিনি একটি অপদেবতার পাল্লায় পড়েছেন। তার হাত দুটো তার গলায় যেন চেপে বসছে আর লম্বা পা দুটো দিয়ে তাকে সাঁড়াশির মত জাপ্টে ধরে মাটিতে পেড়ে ফেলতে চাইছে। মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় শবব্যবচ্ছেদ করতে হয়েছে। অনেক মরা মানুষ ঘাঁটাঘাঁটি করতে হয়েছে তবু তিনি কখনো এরকম ঘাবড়ে যাননি। কিন্তু আজ সন্ধ্যের এমন ঘটনায় তিনি আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। কোনোক্রমে বাচ্চা বা বুড়োটাকে নিজের পিঠ থেকে এক ঝাড়া দিয়ে নামিয়ে ক্যানেলের উপর ফেললেন। তারপর পড়িমড়ি করে ছুটে চললেন গ্রামের দিকে। এক লহমায় ছুটে এসে দীনু পালের খামার বাড়ির সামনে তিনি পড়ে গেলেন। জ্ঞান হারালেন। দীনু পাল আর তার পরিবারের লোকেরা ছুটে এসে ডাক্তারবাবুকে চিনতে পারলেন। চোখে মুখে জল ছিটিয়ে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করলেন। প্রায় ঘন্টাখানেক পরে ডাক্তারবাবুর জ্ঞান ফিরল। কিন্তু তিনি কাউকে চিনতে পারলেন না। কিছু বলতে পারছেন না। কিন্তু সারা শরীরে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। সম্পর্কে জ্যাঠামশাই বয়স্ক বিরিঞ্চি পাল দেখতে এসে বুঝলেন জনার্দন ভয় পেয়েছে। এ নির্ঘাত ভুতের ভয়। কালীর থানে জবা ফুল নিবেদন করে পুজো দিলেন তারপর মুখে হাতে সেই প্রসাদী ফুল ছোঁয়ালেন।

এর কিছুক্ষন পরে জনার্দন ডাক্তারের মুখে কথা ফিরে এলো। সবাইকে চিনতেও পারলেন। তারপর তিনি সব কথা খুলে বললেন।

সবকিছু শুনে বৃদ্ধ বিরিঞ্চি পাল বললেন ,”আগেই বুঝেছি জনাকে মধুসূদন ধরেছিল। আমাদেরই জ্ঞাতি। ছেলেটা খুব ছোটবেলায় ক্যানেলের জলে ডুবে মরেছিল। মাঝে মাঝে বাচ্চা ছেলের রূপ ধরে ফিরে আসে।”

……০……

অংকনঃ পুণ্যতোয়া

Leave a comment

Check Also

দর্পণে

দর্পণে – নির্মাল্য ঘরামী    

    -চল, আমি জোরের সঙ্গে বললাম, -ওসব একদম ভাবিস না। তোকে এতদিন পরে পাচ্ছি, …

ফয়সালা

ফয়সালা – নির্মাল্য ঘরামী

  -দেখুন স্যার। বলে সিকিউরিটি গার্ডটি বিজয়ীর দৃষ্টিতে মহাকুলসাহেবের দিকে তাকালো। তার হাতে ধরা ব্যাগটির …

রক্তগোলাপ/ মৌসুমী পাত্র/ পুণ্যতোয়া ধর

রক্তগোলাপ – মৌসুমী পাত্র

  একটা মোটা দড়ি থেকে পাশাপাশি ঝোলানো সারি সারি মৃতদেহ। ছাল ছাড়ানো। গত কদিন ধরেই …

যখন অন্ধকার হাতছানি দিল

যখন অন্ধকার হাতছানি দিল – নির্মাল্য ঘরামী

  আলোটা এবারে দপ করে নিভে গেল। -যাহ! ওর মুখ দিয়ে শব্দটা প্রতিবর্তক্রিয়ার মতন-ই বেরিয়ে …