Home / গল্প / উপেক্ষিতা – মৌসুমী পাত্র

উপেক্ষিতা – মৌসুমী পাত্র

উপেক্ষিতা। মৌসুমী পাত্র
শিল্পী- মধুমিতা ঘোষ

 

 

“দেবী! অনুগ্রহ করে গাত্রোত্থান করুন। ঊষাদেবী রথে আসীন হয়ে গগনপথ পরিক্রমায় বেরিয়েছেন।”

ধীরে, অতি ধীরে প্রভাতে কুমুদ প্রস্ফুটিত হবার মতোই নয়নদুটি অর্ধ উন্মীলিত হল ঊর্মিলার। পরক্ষণেই অতিশয় ক্লান্ত অনুভব করলেন তিনি। পুনরায় একটি দিবস অতিবাহিত করার অমোঘ যন্ত্রণা!

প্রভাতের অরুণকিরণ স্বচ্ছ তিরস্করণীর আবরণ ভেদ করে গৃহাভ্যন্তরে নানাবিধ আলপনা অঙ্কনে রত। অজান্তেই একটি দীর্ঘশ্বাস মোচিত হল অনুপম দেহবল্লরী থেকে। এই স্বল্প সময়টুকুই, যতক্ষণ পর্যন্ত ময়ূখমালী তাঁর রশ্মিজাল গৃহাভ্যন্তর থেকে প্রত্যাহার না করছেন, তিনিও কোমল অঙ্গুলিতে আলপনা দিতেন আর্যপুত্রের দেহে। পরম ঈপ্সিত সময়টুকু কেটে যেত বড়োই দ্রুত। অবুঝ বালিকার ন্যায় আবদারও করতেন আরও কিছুক্ষণ প্রিয় সন্নিধানে কাটাবার জন্য। কিন্তু তিনি, অগ্রজের একান্ত অনুগত লক্ষ্মণ, গোপন অস্বস্তিতে ছটফট করতেন। পাছে অগ্রজ অসন্তুষ্ট হন, পাছে অগ্রজ ভাবেন যে তিনি কর্তব্যে অবহেলা করছেন! মাত্র একদিনই শরীর-মনের একান্ত আদানপ্রদানে ব্যস্ত লক্ষ্মণের কিছুটা বিলম্ব ঘটেছিল। আর্যপুত্রের নিকট পরে শুনেছিলেন যে অগ্রজ মৃদু হাস্যে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “বধূমাতা কুশলে আছেন তো, লক্ষ্মণ?” নিতান্তই সরল পরিহাস, কিন্তু বাধ্য ভ্রাতা বিলম্ব করেননি আর কোনদিনই।

“দেবী, গাত্রোত্থান করে প্রস্তুত হয়ে নিন। আপনার শ্বশ্রূমাতারা প্রতীক্ষায় থাকবেন।”

বড় বিশ্বস্ত এই পরিচারিকা, সেবন্তী। পিতৃগৃহ থেকে শ্বশুরালয়ে আগমনকালে পিতা সীরধ্বজ জনক চার ভগিনীর প্রত্যেককে এক লক্ষ গো, অনেক উৎকৃষ্ট কম্বল, অনেক ক্ষৌম বস্ত্র, এক কোটি সামান্য বস্ত্র, উত্তম উত্তম বহু দাস দাসী, হিরণ্যনিচয়, বহু সুবর্ণ, অনেক মুক্তা, বহু বিদ্রুম, যথাযথ অলঙ্কারে শোভিত হস্তী, অশ্ব ও পদাতিক সমন্বিত দিব্য সৈন্য এবং সেই সঙ্গে প্রত্যেককে একশত করে সখীস্বরূপা কন্যা যৌতুক দিয়েছিলেন। সেবন্তী ছিল তাদের অন্যতম। নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও কর্মকুশলতার জোরে সেই এখন তাঁর প্রধান পরিচর্যাকারিণী।

প্রস্তুত হয়ে নিলেন ঊর্মিলা। সেবন্তী যথার্থই বলেছে। শ্বশ্রূ সুমিত্রা, স্বশ্রূ কৌশল্যা প্রতীক্ষায় থাকবেন। তাঁরাও তো তাঁরই মতো মন্দভাগ্য। আর্যা কৌশল্যা আপন স্বামীর অনাদর যদি বা সহ্য করেছিলেন, কিন্তু উপর্যুপরি একমাত্র পুত্রের বনবাস আর স্বামীর মৃত্যুতে সদা মুহ্যমান। আর তাঁর আপন শ্বশ্রূমাতা সুমিত্রার এক পুত্র বনবাসে, অন্য পুত্র নন্দীগ্রামে। বনবাসের আদেশ তো প্রকারান্তরে তাঁদের তিনজনেরও। মাতা কৌশল্যা, মাতা সুমিত্রা আর তিনি। আজকাল দিবসের বেশির ভাগ সময় তাঁরা তিনজনে একত্রেই অতিবাহিত করেন।  কারাবাসে যারা নিক্ষিপ্ত হয়, তারা কি কারাবাস ভোগ করে, নাকি আরো বেদনাঋদ্ধ কারাবাসের যন্ত্রণা ভোগ করে তার আত্মীয়স্বজন? দুঃখের দুঃসহ দহনের মধ্যেই নিরন্তর এক অন্তঃসলিলা অপমান তাঁর নিত্যসঙ্গী। স্বামীবিহীন দিনযাপনের  দুঃখ, নাকি এই স্বামীকৃত অপমান- কোনটার দহন বেশি?

 

পিতা জনক বার্তা পাঠিয়েছিলেন মিথিলায় থাকার জন্য। তিনি রাজী হননি। দুই শ্বশ্রূমাতা যে এখন একান্তভাবে তাঁর উপরই নির্ভরশীল। তিনি চলে গেলে এই দুই জীবন্মৃতা রমণীর পরিচর্যার ভার কে নেবে?

কিঞ্চিৎ বিলম্ব হলেই উতলা হয়ে পড়েন শ্বশ্রূমাতারা। এই বিশাল রাজপুরীতে দুই বিধবা নারী এবং এক স্বামীপরিত্যক্তা রমণীর নিবিড় সখ্য রচিত হয়েছে এই বিগত বৎসরগুলিতে। সপ্ত বৎসর অতিক্রান্ত, সম্মুখে আরো সপ্ত বৎসর! তিনি যেন পদচারণা করতে করতে এক দিগন্তবিস্তৃত মরুভূমির মধ্যস্থলে উপস্থিত। পশ্চাতে রুক্ষ বালুচর, আর সম্মুখে অনন্ত পথ! অযোধ্যার রাজপ্রাসাদের আনাচে কানাচে কান পাতলেই হাহাকার কর্ণগোচর হয়। কিন্তু বনবাস কি কেবল তিনজনেরই? বনবাসের থেকেও বৃহত্তর কোন বনবাস যদি থেকে থাকে, তবে তার যন্ত্রণা তো প্রতি মুহূর্তেই তিলে তিলে ভোগ করছেন তিনি। অগ্রজা সীতা রাজপ্রাসাদের হাজারো বিধিনিষেধের বেড়াজালের বাইরে স্বামীকে পেয়েছেন নিবিড়ভাবে। অনুমান করা কষ্ট নয় যে, তাঁরা পরস্পর পরপরে মগ্ন। আর তাঁর স্বামীরত্নটি তো তাঁদের সেবা করতে পেলেই ধন্য।

নয়নদ্বয় জ্বালা করে উঠল ঊর্মিলার। একবার, একবারের জন্যও কি বিদায় নিয়ে যেতে পারতেন না লক্ষ্মণ? রাম কি পারতেন সীতাকে না জানিয়ে বনবাসে যেতে? তাহলে কেন তুমি… তাঁর একান্ত অনুগত ভাই, সম্পূর্ণ বিপরীত আচরণ কেন, হে দাশরথি?

অঙ্গসংবাহন সমাপ্ত। সুরভিত জল প্রস্তুত করে রেখেছে সেবন্তী। মৃদু চম্পকসৌরভ নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করতেই দহনজ্বালা যেন অনেক স্তিমিত হয়ে এল। আহ! আর্যপুত্র এখন এই মুহূর্তে কী করছেন? অরণ্যে শিকার করতে বেরিয়েছেন নাকি ভ্রাতা, ভ্রাতৃবধূর রন্ধনের প্রস্তুতিপর্ব সারছেন?

একফোঁটা নয়নবারি নির্গত হয়ে মিশে গেল পাত্রের চম্পকসুরভিত জলে।

 

“ঊর্মি! ঊর্মিলা!”

“মাতঃ! আপনি শয়ন করুন। আমি আপনার পদসেবা করি।”

“নাহ্‌। তার প্রয়োজন নেই পুত্রী। আজ রামের বনবাসের সপ্তবর্ষ অতিক্রান্ত হল।”

ঊর্মিলা অপাঙ্গে দেখলেন সুমিত্রাকে। তাঁর দিকেই তাকিয়ে। শ্বশ্রূ- বধূমাতায় নয়নের ইঙ্গিতে কথার আদানপ্রদান হয়ে গেল নীরবে। কৌশল্যাকে আজ কিঞ্চিৎ বেশিই বিচলিত দেখাচ্ছে।

“ঊর্মিলা, চলো, আজ তোমার বেণীবন্ধন করে তোমাকে সাজাই।”

প্রতিবাদ করে লাভ নেই জানেন তিনি। তবুও মৃদু প্রতিবাদ না করে পারলেন না, “মাতঃ! আজ বরং থাক। আপনার শরীর আজ সুস্থ নেই।”

“ঊর্মিলা, বসো পুত্রী। রাম- লক্ষ্মণ-সীতা কেউ নেই, ভরত- শত্রুঘ্ন তাদের মতো রাজ্যপাট সামলাতে ব্যস্ত, তুমি নিকটে থাকলে অন্তর্জ্বালা তবু কিছুটা প্রশমিত হয়, পুত্রী।”

ঘনকৃষ্ণ কেশদাম উন্মুক্ত করলেন ঊর্মিলা। ঊর্মিমুখর তরঙ্গের মতোই কুন্তলদাম বিস্তৃত হল পৃষ্ঠে। লঘু অথচ সুনিপুণ হস্তে বেণী রচনা করছেন কৌশল্যা। সুমিত্রা অপলকে তাকিয়ে দেখছিলেন। কৌশল্যার বিষাদখিন্ন কণ্ঠস্বর সহসা বেজে উঠল কানে, “জানো সুমিত্রা, আত্মধিক্কার হয় আজকাল, প্রবল আত্মধিক্কার।”

ভ্রূদ্বয় ঈষৎ কুঞ্চিত হয় সুমিত্রার। জিজ্ঞাসা ঊর্মিলারও অন্তরে। কৌশল্যা আত্মগত ভাবেই বলে চলেন, “আমার রামের বনবাসের দিনটির কথা একবার স্মরণ করো দেখি। কোথায় রামের রাজ্যাভিষেক হবে, রাজমাতা হয়ে আমার যন্ত্রণার কিঞ্চিৎ উপশম হবে! হা হতোস্মি! আর এই অভাগিনীটির কথাই ভাবো তো দেখি। রাম- সীতা- লক্ষ্মণ একত্রে বনবাসে গমন করল, কিন্তু এই অভাগিনী! আজ সপ্তবর্ষ এই হতভাগিনী স্বামী সৌভাগ্যে বঞ্চিত। সেদিন আমি পাগলিনীপ্রায়, ঊর্মিলার কথা আমার স্মরণপথে বারেকের তরেও উদয় হয়নি। কিন্তু তুমি লক্ষ্মণমাতা, পুত্রকে তো বলতে পারতে ঊর্মিলার থেকে বিদায় নিতে।”

সুমিত্রা চুপ। নীরবে স্মৃতি রোমন্থন করছেন। ঊর্মিলার কথা তাঁর স্মরণপথে উদিত হয়নি, এমত নয়। কিন্তু সেই সময়কার যা পরিস্থিতি, তিনি সাহস করে ঊর্মিলার প্রসঙ্গ তুলতে পারেননি। আর লক্ষ্মণকেই বা কী বলতেন? ঊর্মিলাও যদি স্বামীর সঙ্গে বনবাসে যাবার বায়না করত! সেও জনকদুহিতা, রঘুকুলবধূ- যেতে চাইলে অহেতুক বিড়ম্বনার সৃষ্টি হত। নিজের পুত্রের বনবাসযাত্রার দুঃখ সহ্য করে কৌশল্যাকে প্রবোধ দেওয়া, অচেতনপ্রায় স্বামীর শুশ্রূষা করা – তিনি নিজেই কি খুব সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থায় ছিলেন?

বিন্দু বিন্দু বারি নয়নপথ থেকে নির্গত হয়ে কপোল সিক্ত করছে ঊর্মিলার- নিঃশব্দ শিশিরবিন্দুরা যেন সিক্ত করছে ধরিত্রীর বক্ষস্থল। মনান্তর, মতান্তর কিছুই তো হয়নি আর্যপুত্রের সঙ্গে। অপমান করে তাঁকে পদদলিত করে চলে গেলেও বুঝিবা এই উপেক্ষার কন্টক প্রতি মুহূর্তে এত নিষ্ঠুর হয়ে বাজত না!

সেই দিনটি- চন্দ্র পুনর্বসু নক্ষত্র থেকে পুষ্যা নক্ষত্রে গমন করেছেন। অযোধ্যানগরীর হিমাদ্রিশৃঙ্গের ন্যায় দেবালয়, চতুষ্পথ, রথ্যা, চৈত্যবৃক্ষ, অট্টালিকা, সমুচ্চ তরুরাজি, নানাবিধ পণ্যদ্রব্যে শোভিত বিপণি এবং সুসমৃদ্ধ শোভাসম্পন্ন গৃহস্থ ভবন সমুদায়ে ধ্বজাসকল উত্তোলিত করা হয়েছে। প্রজাবাসীরা পরমানন্দে নট, নর্তক ও গায়কদের সুমধুর গীত শ্রবণে রত। অযোধ্যানগরী ক্ষুদ্র বৃহৎ পতাকাসমূহে সুসজ্জিতা; রাজপথগুলি জলসিক্ত ও শ্বেত ও নীলবর্ণ কমলদলে সমাকীর্ণ। অন্তঃপুর ও নগর-দ্বার সকল চন্দনচর্চিত, মাল্যে সুশোভিত, ঘ্রাণ- মনোহর ধূপে সুবাসিত। পাকশালায় রাশি রাশি অন্ন, ক্ষীর ও দধির প্রস্তুতি চলছে।  কোথাও ব্রাহ্মণগণ মালা ও মিষ্টান্নহাতে উচ্চৈঃস্বরে স্তুতিপাঠ করতে করতে চলেছে; বাদ্যধ্বনি হচ্ছে সর্বত্র; দেবালয়গুলির দ্বারদেশ সুধাধবলিত। নাগরিকগণ পরম পুলকিত। এমনকি, শ্রেষ্ঠ হস্তী, অশ্ব ও গাভী ও বৃষভগণও হৃষ্ট হয়ে আনন্দধ্বনি করছে।

প্রত্যূষে উঠে প্রসাধনরত ছিলেন তিনিও। স্নানান্তে পট্টবস্ত্রে সজ্জিতা- সেবন্তী লঘু পরিহাস করছিল, দেবী, আজ থেকে তো আপনি কনিষ্ঠা যুবরানী!

হৃদয়ের মধ্যে সুখের মৃদু কম্পনের নিয়ত অনুরণন অনুভব করতে পারছিলেন। তারপরই সেই অঘটন। কোন দাসী এসে সংবাদ দিয়ে গেল, রাম রাজা হচ্ছেন না। শ্বশ্রূমাতা কৈকেয়ী কিসব কুমন্ত্রণা দিয়েছেন।   প্রবল উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। দাসীদের নিরন্তর কানাকানি। নানাবিধ রটনার মধ্য থেকেই প্রকৃত ঘটনা যথাসম্ভব অনুমান করার প্রচেষ্টা। সেবন্তী সংবাদ সংগ্রহে বেরিয়েছিল, সেই বহন করে আনল দুঃসংবাদ। কৈকেয়ীর শর্তমতো রাম বনবাসে গমন করছেন, সীতা অনুগামিনী হচ্ছেন। এই পর্যন্ত বলে চুপ হয়ে গিয়েছিল সেবন্তী।

“আর দাশরথি লক্ষ্মণ!”, সুতীক্ষ্ণ আর্তনাদ বেরিয়ে এসেছিল তাঁর কণ্ঠ চিরে।

সেবন্তী উত্তর দিতে পারেনি। ঝরঝর বারিধারায় সিঞ্চিত হয়েছিল তার অঙ্গাবরণ। উন্মাদিনীর ন্যায় তিনি ঝাঁকিয়েছিলেন সেবন্তীকে, “চুপ করে থাকিস না, সেবন্তী। বল্‌, আর্যপুত্র কী করছেন?”

স্খলিতকণ্ঠে কোনমতে বলেছিল সেবন্তী, “আর্য লক্ষ্মণ রাম-সীতার অনুগামী হচ্ছেন বনবাসে।”

সহস্র বজ্রাঘাত যেন এক লহমাতেই জীর্ণ করেছিল তাঁর হৃদয়। রাজান্তপুরের অনুশাসন ছিন্ন করে ছুটে যেতে চেয়েছিলেন আপন স্বামীর সন্নিকটে, দাসীরা নিবৃত্ত করেছিল। সেবন্তী আশ্বাস দিয়েছিল, বিদায়ের প্রাক্কালে নিশ্চয়ই রামানুজ বিদায় নিতে আসবেন আপন পত্নীর নিকট। তিনিও স্থির করেছিলেন, অগ্রজা সীতার ন্যায় স্বামীর অনুগামিনী হবেন তিনিও। স্বামীর সম্মতি আদায় করবেন যেকোন প্রকারে। কাল্পনিক যুক্তিজাল গোছাচ্ছিলেন মননে।

সামান্যতম শব্দেও চমকিত হয়ে উঠছিলেন। দাসীদের সংবাদ সংগ্রহের জন্য প্রেরণ করছিলেন ক্ষণে ক্ষণে। পরস্পরবিরোধী সংবাদ- সত্য মিথ্যার প্রভেদ করা মুশকিল। দ্বিপ্রহর অন্তে প্রবল কান্নার রোল উঠল চতুর্দিকে- তার কিয়ৎক্ষণ পরেই অন্য এক দাসী সংবাদ বহন করে আনল যে, রাম- সীতা ও লক্ষ্মণ রথে চড়ে নগরীর বাইরে চলে গেছেন। অজ্ঞান হবার ঠিক পূর্বমুহূর্তে অবচেতনে ধরা পড়েছিল বাতায়নের বাইরে অশ্বকর্ণের বিশাল পত্রে একলা এক পাখিকে।

 

আজো গবাক্ষে একলা চঞ্চল পাখিকে দেখে পুরাতন দুঃখের স্মৃতিগুলি ঝলক দিয়ে উঠল যেন।

কী যে দুঃসহ দিন কেটেছে সেসময়। সেবন্তী যেন মায়ের মমতা দিয়ে আগলে রেখেছিল তাঁকে। পিতা জনক মিথিলায় নিয়ে যেতে এসেছিলেন। যাননি তিনি। স্বামীপরিত্যক্তার কলঙ্ক নিয়ে পিতৃগৃহে দিনযাপনের গ্লানি সহ্য করার শক্তি ছিল না। তার ওপর দুই শ্বশ্রূমাতা। পতিদেব কোন দায়িত্ব অর্পণ করে যাননি ঠিকই, তবু এ দায়িত্ব তো তাঁরই ওপর বর্তায়।

“পুত্রী, দেখো তো, বেণীবয়ন পছন্দ হল কিনা?”

কৌশল্যার কবরীবন্ধন শেষ। উদ্গত নয়নাশ্রু উত্তরীয়ের প্রান্তভাগে মুছলেন অতি সন্তর্পণে। লঘুস্বরে বললেন, “মাতঃ, আপনার কবরীবন্ধন সত্যই অনবদ্য।”

প্রশংসার দৃষ্টি সুমিত্রার নয়নেও। যেমন অপূর্ব তাঁর লক্ষ্মণের দিব্যকান্তি, তেমনই অপরূপা বধূমাতা ঊর্মিলা। নিখাদ স্বর্ণের  ন্যায় দিব্যপ্রভা, কজ্জলকৃষ্ণ দুই চক্ষুতে ঘনশ্যাম মেঘের ছায়া, অর্ধ্বউন্মীলিত কমলের ন্যায় ওষ্ঠাধর। কৌশল্যার সুনিপুণ হস্তে রচিত বেণীটি যেন একটি মুকুটের ন্যায় সেই সুন্দর আননটিকে বেষ্টিত করতে পেরে যেন ধন্য। কী সুতীব্র যন্ত্রণা অন্তঃসলিলা ফল্গুর ন্যায় নিরন্তর দুঃখের দহন বহমান এই নারীর অন্তরে, অথচ তার প্রকাশ কি অনুপম সংযম ও শালীনতায় আবৃত! পুত্র লক্ষ্মণ সীতার বস্ত্রালংকারের পেটিকা বহনের দায়িত্ব স্বেচ্ছায় স্বীয় স্কন্ধে তুলে নিয়েছে, অথচ তারই স্ত্রীর উত্তম বসন ভূষণ পরার অধিকারটুকুও যেন নিমেষে  হরণ করেছে কেউ!

“দেবী! অলক্তকসংবাহিনী এসেছে। ভেতরে প্রেরণ করব?”

সচকিত হন সকলেই। ইঙ্গিতে সম্মতি প্রদান করেন কৌশল্যা।

অলক্তকসংবাহিনী এসে তার পেটিকা নামিয়ে রাখে। কৌশল্যা বলেন, “তুমি আজ বধূমাতাকে উত্তম রূপে সজ্জিত কর দেখি। বধূমাতা প্রসাধনবিহীনা হয়ে থাকেন- আমার সহ্য হয়না।”

অন্তরাত্মা বিদ্রোহ করে উঠছে ঊর্মিলার। নিরর্থক, সকলি নিরর্থক! স্বামীই যদি অনায়াসে উপেক্ষা করে চলে যেতে পারেন, তাহলে এসব বাহ্যিক আড়ম্বরের কিবা প্রয়োজন? তিনি কি বালিকা যে ক্রীড়নকের ন্যায় এইসব প্রলোভনে ভুলে থাকবেন!

পরমুহূর্তেই তীব্র আত্মদংশন হয় তাঁর। ছি! ছি! এ কী ভাবছেন তিনি! সন্তানহারা এক মাতা যদি তাঁকে সাজিয়ে গুজিয়ে নিজের স্বামী সন্তানের দুঃখ স্বল্পকালের জন্যও বিস্মৃত হন, তবে তাতে ক্ষতি কী?

নিপুণ হস্তে অঙ্গসজ্জা করছে অলক্তকসংবাহিনী। কোমল অঙ্গুলিদ্বয় যেন অবলেপন করে দিতে চাইছে তাঁর সমস্ত যন্ত্রণা, সকল অপমান! আহ! যেন জননীর নিবিড় করস্পর্শের অনুভূতি! আবেশে চক্ষু মুদিত হয়ে আসতে চাইছে।

“মাতঃ, ভোজনের বন্দোবস্ত করি? অনুমতি করুন।”

“ভোজন? সুনয়না, আমার জন্য সামান্যই শাকাহার রাখিস।”

মাতা কৌশল্যার প্রধান দাসী সুনয়না। ঊর্মিলার প্রসাধন এতক্ষণ অপলকে তাকিয়ে দেখছিল সে। মাতা কৌশল্যার সম্ভাষণে বিহ্বলতা কাটিয়ে সচকিত হয় সে, “মাতঃ, আমি আয়োজন করেই রেখেছি। আপনারা আচমন করে প্রস্তুত হন।”

“সুনয়না, অলক্তকসংবাহিনীকে উপযুক্ত পারিতোষিক প্রদান কর। বধূমাতা ঊর্মিলাকে মনোহর রূপে সজ্জিত করেছে সে।”

……………

 

অন্তঃপুরিকারা আজ প্রায় সকলেই গিয়েছে নাট্যশালায় অভিনয় দেখতে। সেবন্তীকেও একরকম জোর করেই প্রেরণ করেছেন তিনি। তারও তো কিছুটা বিনোদনের প্রয়োজন। অযোধ্যায় মহিলাদের জন্য পৃথক নাট্যশালার ব্যবস্থা আছে। সেবন্তী তাঁকেও বারংবার অনুরোধ করেছিল যাবার জন্য। শ্বশ্রূমাতারাও আপত্তি করতেন না। কিন্তু অদ্ভুত এক নিরাসক্তির প্রান্তে পৌঁছে গেছেন তিনি ইদানীং। এমনকি, আর্যপুত্রের প্রতি সেই সীমাহীন ক্ষোভেও ভাঁটা পড়েছে যেন আজকাল। যান্ত্রিক নিয়মেই শ্বশ্রূমাতাদের সেবা করেন, অন্যান্য করণীয় কাজকর্ম সম্পাদন করেন। কিন্তু আজ পরিচারিকাদের নাট্যাভিনয় দর্শনের কথা শুনে মনে হয়েছিল, নিজের সঙ্গে নিজে একান্তে কিয়ৎক্ষণ কাটানোর এই তো অবসর।

গৃহের বাতিগুলি একে একে নির্বাপিত করলেন তিনি। কেবলমাত্র ঘরের কোণে রাখা তৈলাধারের প্রদীপশিখা গৃহের বাকি অংশের নিঃসঙ্গতা দ্বিগুণ বর্ধিত করেছে।

বিবাহের সময় কতই বা বয়স ছিল তাঁর? মাত্রই পাঁচ বৎসর। বিবাহ কী বস্তু তাই অনুধাবন করার বয়স হয়নি। তবুও পরিজনদের কথাবার্তায়, পরিচারিকাদের ইঙ্গিতে বালিকার স্বাভাবিক অনুভূতিতেই ধারণা হয়ে গিয়েছিল যে, কন্দর্পকান্তি ওই তরুণটিই তাঁর জীবনের ভরকেন্দ্র হতে চলেছেন।

ভরকেন্দ্র? হয়তো তাই। আজ এই সুদীর্ঘ দশ বৎসর তিনি পতি বিনা বসবাস করছেন, তবুও যেন তাঁর নিত্যকর্ম সকলই সেই অনুপস্থিত পুরুষটিকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। কিন্তু আর্য লক্ষ্মণ? তাঁর জীবনের কোনোখানে কি তিনি, ঊর্মিলা আছেন? দিনান্তে কি একবারও দাশরথি স্মরণ করেন তাঁকে? স্মরণ যদি নাই করেন, তাহলে বিবাহ শব্দের অর্থই বা কী? আর যদি স্মরণ করেন, তাহলে বিবাহিতা পত্নীকে নির্বিচারে পরিত্যাগ করার অর্থই বা কী?

অগ্রজা সীতা? তিনিও কি বিস্মৃত হয়েছেন ভগিনীর কথা? মিথিলায় বালিকাবয়সে কত ক্রীড়া করতেন দুজনে! পুত্তলিকাগুলি নিয়ে কতই না বিবাদ! দাসীরা এসে নিবৃত্ত করত। তারপর একসঙ্গে স্নানাহার সেরে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে পরম শান্তির নিদ্রা! একই রাজপরিবারের দুই ভ্রাতার সঙ্গে পরিণয় সম্ভাবনায় পরম উৎফুল্ল হয়েছিলেন দুজনেই। সেই অগ্রজা সীতা, আপন স্বামীসঙ্গলাভের বাসনায় পুরোপুরি বিস্মৃত হলেন তাঁকে? বারেকের তরেও কি লক্ষ্মণকে বলা যেত না যে ঊর্মিলাকেও সঙ্গে নাও। দুই ভগিনীতে একসঙ্গে বনবাসের কাল অতিবাহিত করব!

নাসিকা স্ফূরিত হয়ে উঠল ঊর্মিলার। অগ্রজা সীতা? তিনি তো পিতা সীরধ্বজ জনকের আপন ঔরসজাত দুহিতা নন, তবু সব সুখৈশ্বর্যের জ্যেষ্ঠভাগের অধিকারী যেন তিনিই! আর ঊর্মিলা একান্ত আত্মজা হয়েও প্রতি পদে বঞ্চিতা। স্বামীসঙ্গলাভের ন্যূনতম অধিকারটুকুও যেন দিতে অস্বীকৃত সকলে!

পরক্ষণেই তীব্র আত্মদংশন হয় তাঁর। এ কী ভাবছেন তিনি? সীতা অগ্রজা, অগ্রজার সম্মানটুকু তাঁর প্রাপ্য। আর একথা তো অনস্বীকার্য যে রামের বনবাসের সংবাদের আকস্মিক অভিঘাতে সকলেই প্রায় উন্মাদপ্রায় হয়ে গিয়েছিল। কে কার কথা চিন্তা করে তখন? আর্য লক্ষ্মণও হয়তো ব্রীড়াবশতঃই ঊর্মিলা সমীপে আসতে পারেননি। খুবই সম্ভব।

সহসাই চোখে পড়ল ঊর্মিলার, কোণের দীপশিখাটিকে ঘিরে ঘূর্ণায়মান একটি পতঙ্গকে। উজ্জ্বল নীলবর্ণের পতঙ্গটি পাক খাচ্ছে দীপশিখাকে ঘিরে। রাজকীয় তার ভঙ্গি। পতঙ্গটি দৃষ্টি আকর্ষণ করল ঊর্মিলার। আচমকা উড়ে এল আরো একটি পতঙ্গ। এবারে জোড়ায় তারা ঘুরতে থাথাকল আলোকবর্তিকার চারিপাশে। কিয়ৎক্ষণ পর উড়ে এল আরো একটি পতঙ্গ। জোড়ায় পরিক্রমণকারী পতঙ্গদ্বয়ের থেকে সামান্য দূরত্ব রেখে ঘুরতে থাকল সেও। ঊর্মিলা অপলকে দেখছেন এই ত্রয়ীকে। কিন্তু তাঁর বিস্ময়ের তখনো কিছু বাকি ছিল। চতুর্থ একটি পতঙ্গ এবার উড়ে এল। তৃতীয় পতঙ্গের সঙ্গী হতে চাইছে বুঝিবা। কিন্তু যতবারই নবাগত পতঙ্গটি কাছে যেতে চাইছে, ততবারই যেন সে ঝটকা দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে। কিসের এত বীতরাগ? এত বিতৃষ্ণা?

বাইরে কোলাহল এগিয়ে আসছে দ্রুত। সেবন্তীরা নাট্যাভিনয় দর্শনান্তে ফিরছে। অর্গল মুক্ত করলেন তিনি। আর সেই সুযোগে পতঙ্গগুলিও বেরিয়ে গেল খোলা পথে।

…………

 

অনুপম দেহবল্লরী শয্যার সঙ্গে মিশে গেছে প্রায়। উপাধানের পাশেই রৌপ্যনির্মিত পাত্রের জল ঈষৎ অস্বচ্ছ। সেবন্তী ও আরো দুজন সখী পরম মমতায় জলপট্টিকা দিচ্ছে ঊর্মিলার মস্তকে। প্রভাতের অরুণকিরণে প্রাণচঞ্চল কুমুদ যেমন অস্তরাগে বিষণ্ণ আকার ধারণ করে, সেরকমই নিস্তেজ আনন ঊর্মিলার। তবুও, তারই কত বাহার! অপলকে দেখছিল সেবন্তী। পূজ্যপাদ রাম-লক্ষ্মণের বনবাসের ত্রয়োদশ বর্ষ পূর্ণ হল আজ।  জলপট্টিকাটি হাতে নিল সেবন্তী। কপালের তাপে জলপট্টিকাটি কিঞ্চিৎ উষ্ণ। পাত্রের শীতল জলে সেটিকে নিমজ্জিত করে জল থেকে অন্য একটি জলপট্টিকা নিয়ে ঊর্মিলার শিরে পুনরায় পরম মমতায় বিছিয়ে দেয়।

বুক চিরে সহসাই একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে সেবন্তীর। আর্য লক্ষ্মণের বিরহে প্রথম এক বৎসর উন্মাদিনীপ্রায় হয়ে গিয়েছিলেন ঊর্মিলা। রাজবৈদ্যদের ডাক পড়ত প্রায়ই। নানারকম ভেষজ প্রয়োগ করে একরকম তাঁকে নিদ্রাভিভূত করেই রাখা হত। সামান্য সুস্থ থাকলেই নানা ব্রত, উপবাস, তপস্বিনীর ন্যায় জীবনচর্যা। প্রাণধারণের ইচ্ছেটুকুও যেন চলে গিয়েছিল। প্রায়ই বিলাপ করতেন। একদিন একান্তে বলেছিলেন, “সেবন্তী, অপমানের বেদনা চরম কঠোর হলেও সহ্য করা যায়, অনাদরে হৃদয় দীর্ণ হলেও মানিয়ে নেওয়া যায়, কিন্তু উপেক্ষা? এ জ্বালা যে বোঝার সেই বোঝে।”

জলপাত্রের জল পরিবর্তন করে আনল এক সখী। অভাগিনী ঊর্মিলার শরীর মনের তাপে পাত্রের জল উত্তপ্ত। ঊর্মিলার ন্যায় এমন মন্দভাগ্য আর কে আছে এই অযোধ্যায়? অযোধ্যার অলিতে গলিতে কথাবার্তায় ঘুরে ফিরে আসে রাজমাতা কৌশল্যা- সুমিত্রার কথা, রাজা দশরথের ইন্দ্রিয়পরায়ণতার কথা, রাম-লক্ষ্মণ-সীতার বনবাস যাত্রাকালের কথা। কিন্তু ঊর্মিলা যেন বিস্মৃতির আড়ালে। সে যেন ছিল না কোনকালেই, এখনও নেই।

“দেবী ঊর্মিলা কেমন আছেন? রাজমাতা কৌশল্যা, সুমিত্রা সংবাদ নিতে বললেন। ওঁরা উদ্বিগ্ন।”

সুনয়না এসে দাঁড়িয়েছে ঊর্মিলার উপাধানের পার্শ্বে।

“উত্তাপ গতকালের তুলনায় কম। রাজবৈদ্যের পথ্যাদি চলছে। সন্ধ্যার পূর্বে আসবেন বলে জানিয়েছেন।”

“দেবী ঊর্মিলা তো আহারাদি প্রায় করেনই না। তুমি তো জানো, আমি রোজই পঞ্চব্যঞ্জন সাজিয়ে দিই। কুলিঙ্গক পক্ষীর ন্যায় আহার করেন।”, আক্ষেপ ঝরে পড়ছে সুনয়নার কন্ঠে, “এত স্বল্পাহারে প্রতিরোধ ক্ষমতা কার্য করছে না।”

“আচ্ছা।” সুনয়না চলে গেল।

 

মৃদুস্বর কানে এল সেবন্তীর। দেবী ঊর্মিলা কি কিছু বলছেন? মুখের কাছে মুখ নিয়ে গেল সেবন্তী, “কিছু বলছেন, দেবী?”

জ্বরের ঘোরে সোজা হয়ে বিছানায় উঠে বসেছেন ঊর্মিলা, “বলো, বলো, কী অপরাধ আমার? নিজের অগ্রজের স্ত্রীর চরণসেবা করছো দিবারাত্র, আর নিজের পত্নীর বিন্দুমাত্র ধ্যান রাখো না? কেমন পুরুষ তুমি?”

প্রবল উত্তেজনায় কথাকটি বলে আবার শয্যায় এলিয়ে পড়লেন ঊর্মিলা। নিজের মনেই মাথা নাড়ল সেবন্তী। জ্বরবিকারে তাকেই রামানুজ বলে ভুল করেছেন। তাও ভালো। দীর্ঘদিন ধরে মনের মধ্যে পুষে রাখা যন্ত্রণার বাষ্প যদি এভাবে আকাশে মিশে যায়, তাও ভালো।

“সেবন্তী!” অতি লঘু চাপা স্বর।

গলাটা চিনতে ভুল হোল না সেবন্তীর। তুলিকা! অগ্রজা সীতার প্রধানা দাসী। জানকী বনবাসে, তুলিকাও যদৃচ্ছ পরিভ্রমণ করে। গোপালকবিহীন গাভীরা যেমন শৃংখলাবিহীন অবস্থায় বিচরণ করে, সেইরকমই অবস্থা।

তুলিকার মুখ এবার অর্গলের ফাঁকে সামান্য দেখা গেল। ভ্রূপল্লবে, নয়নযুগলে, ওষ্ঠে চাপা উত্তেজনা।

“সসস্‌।”, অধরে আঙুল দিল সেবন্তী, “দেবী ঊর্মিলা অসুস্থ।”

“ও হো! গত কয়েকদিন এদিকে আসা হয়নি। নাট্যশালায় যাচ্ছিলাম। তাই ভাবলাম, তোকে ডাকি।”

“নাহ! নৃত্যগীত আর ভালো লাগে না। একে রাজনন্দিনীর এই অবস্থা। তোর বরং সুযোগ আছে, চঞ্চল ময়ূরীর মত নর্তন করে বেড়া।”

“কী যে বলিস!”, ভ্রূভঙ্গি করল তুলিকা, “তুই দেবীর সেবাশুশ্রূষা কর। আমি আসি। ওবেলা বরং সংবাদ নিয়ে যাবো।”

দ্বারপথে তুলিকার মুখ অন্তর্হিত হয়েছে। সেদিকে তাকিয়ে চোখমুখ জ্বালা করে উঠল সেবন্তীর। দাশরথি লক্ষ্মণ এখন কী করছেন? তাঁর কি দিনান্তে একবারও মনে পড়ে আপন পত্নীর কথা? মাতা বসুমতী কি নিষ্করুণ দ্যাখো! এখানে দীর্ঘ ত্রয়োদশ বৎসরব্যাপী ঊর্মিলা অনুক্ষণ স্বামীচিন্তা করে যাচ্ছেন, আর ওদিকে আর্য লক্ষ্মণের হয়তো পত্নীর কথা ভাবার অবসরমাত্র নেই! নাকি পুরুষজাতি এরকমই! কে জানে?

অভ্যস্ত হাতে জলপট্টিকা ক্রমাগতঃ বদলে যাচ্ছে সেবন্তী আর দুই সখী।

“সেবন্তী!” জ্বরক্লিষ্ট নয়ন মেলেছেন ঊর্মিলা।

মুখের কাছে মুখ নিয়ে যায় সে। “দেবী, ক্লেশ বোধ করছেন?”

“একটু জল খাবো।”

ঊর্মিলার পিছনে উপাধান ন্যস্ত করে ধীরে ধীরে তাঁকে বসিয়ে দেয় সেবন্তী। স্বর্ণপাত্র থেকে ধীরে ধীরে পরম মমতায় জল খাইয়ে দেয়।

“সেবন্তী, গত জন্মে তুই বোধহয় আমার মাতা ছিলি।”, কিঞ্চিৎ সুস্থবোধ করছেন ঊর্মিলা।

“রাজনন্দিনী, বেশি কথা বলবেন না। রাজবৈদ্য উত্তেজনা প্রশমন করতে বলেছেন।”, মেঘমালার সমতুল ঊর্মিলার কেশদামে কোমল অঙ্গুলি চালনা করতে করতে বলে সেবন্তী।

“একবার তিথিটা দেখে বল্‌ তো। আর্যপুত্রের বনবাস গমনের আজ সম্ভবতঃ ত্রয়োদশ বর্ষ পূর্ণ হোল। আজই তো পুষ্যানক্ষত্র-যোগ।”

হা হতোস্মি! নিজের কপালেই করাঘাত করতে ইচ্ছা করে সেবন্তীর। হায় লক্ষ্মণ, এমন পতিপরায়ণা রমণীকে নির্বিবাদে ফেলে যেতে পারলে!

…………

 

মৃদু একটা কলরব কর্ণপথে শ্রুত হচ্ছে কিছুক্ষণ ধরেই। আনন্দগুঞ্জন যেন। ঊর্মিলা উৎচকিত হলেন, “বাইরে কিসের কোলাহল দ্যাখ তো সেবন্তী।”

শোনার চেষ্টা করল সেবন্তী। বনবাসের চতুর্দশ বৎসর পূর্ণ হয়েছে মাত্র গতকাল, পঞ্চমী তিথিতে। দেবী ঊর্মিলা এখন সামান্যতম শব্দেও সচকিত হয়ে পড়েন, ওই বুঝি রামানুজ আগমন করলেন!

“আমি দেখছি, দেবী।”

কক্ষাভ্যন্তর থেকে বেরিয়ে এল সেবন্তী। দীর্ঘ চতুর্দশ বৎসর যাবৎ প্রায় ঘুমন্ত রাজপুরী আনন্দোচ্ছ্বাসে প্লাবিত যেন। রাম-লক্ষ্মণ-সীতার নামে জয়ধ্বনি উঠছে মুহুর্মুহু। অন্তঃপুরের প্রাঙ্গণ অকাল হোলিতে বর্ণে বর্ণে পরিপূর্ণ। পরিচারক পরিচারিকাদের ছুটোছুটি, কলধ্বনি।

হতচকিত হয়ে পড়ে সেবন্তী। তাহলে কি দাশরথি রাম-লক্ষ্মণ, দেবী সীতা প্রত্যাগমন করছেন? ওই তো তুলিকা! অন্য এক পরিচারিকার সঙ্গে উত্তেজিতভাবে কীসব কথায় ব্যাপৃত। ঝটিতি গিয়ে বাক্যালাপে বাধাদান করে সেবন্তী, “কী হয়েছে, তুলিকা? সকলে এত আনন্দমুখর কেন?”

“কোথায় থাকিস তুই? বনবাস অন্তে আমার দেবী সীতা, রাম-লক্ষ্মণ সহ ফিরছেন। নাহ, আমি যাই। গিয়ে প্রসাধন সারি। নইলে দেবী সীতা দেখে কী বলবেন?”

তুলিকা আর কিছু বলার অবকাশ না দিয়েই ত্বরিতগতিতে অন্তর্হিত হোল। সেবন্তী চলল দেবী কৌশল্যার মহলের দিকে। ওই তো, দেবী কৌশল্যার কক্ষ থেকে উদ্ভাসিত মুখে নিষ্ক্রান্ত হচ্ছে সুনয়না।

“সুনয়না!”

সুনয়না সচকিত হয়ে তাকায় সেবন্তীর দিকে। “ও সেবন্তী! রাজা ভরত সংবাদ পাঠিয়েছেন, বনবাস অন্তে রাম লক্ষ্মণ সীতা প্রত্যাবর্তন করছেন অযোধ্যায়। দেবী কৌশল্যা, দেবী সুমিত্রা অল্পক্ষণ পরেই প্রত্যুদ্গমন করবেন। আমি রথ প্রস্তুত করতে বলতে যাচ্ছি।”

 

পরিচারিকা পরিবৃতা হয়ে বসে আছেন ঊর্মিলা। তারারাজি বেষ্টিতা দ্বিতীয়ার চন্দ্রিমার ন্যায়। সেবন্তীর দর্শনেই ব্যাকুল হয়ে পড়লেন ঊর্মিলা, “সেবন্তী, কী সংবাদ?”

“দেবী! দাশরথি রাম- লক্ষ্মণ ও দেবী জানকী প্রত্যাগমন করছেন অযোধ্যায়। মহারাজ ভরতের নিকট এই মর্মে বার্তা পাঠিয়েছেন রঘুনন্দন রাম।”

থরথর করে কেঁপে উঠলেন ঊর্মিলা! হর্ষে, পুলকে নিমেষেই পূর্ণিমার চন্দ্রের ন্যায় উজ্জ্বল হয়ে উঠলেন ঊর্মিলা, পরক্ষণেই সে মুখমণ্ডলে নেমে এল অমাবস্যার অন্ধকার। দীর্ঘ, অতিদীর্ঘ চতুর্দশ বৎসরের কুজ্ঝটিকার আবরণ সরিয়ে প্রিয়মিলনের একান্ত ক্ষণ আগতপ্রায়। কিন্তু সে প্রিয় ততটাই প্রিয় আছেন তো? যেমনটি ছিলেন চোদ্দ বছর আগে! রামানুজ অন্যগমন করেননি তো?

পরমুহূর্তেই সুতীব্র আত্মদংশন হয় তাঁর। ছি! ছি! এ কী কথা ভাবছেন তিনি? রামচন্দ্র যেমন সীতাতে অনন্যচিত্ত- তাঁর ভ্রাতা কি অন্যরূপ হতে পারেন?

সেবন্তী অপলকে তাকিয়ে দেখছিল ঊর্মিলার মুখের বিচিত্র ভাববদল। নয়নের ইঙ্গিতে অন্যান্য পরিচারিকাদের বিদায় নিতে বলে। তারপর ধীর স্বরে বলে, “দেবী, আপনি চিন্তা করবেন না। আর্য লক্ষ্মণ নিরাপদেই ফিরবেন।”

“কিন্তু… কিন্তু… আমাকে কেউ কোন সংবাদ দিল না তো? মাতা কৌশল্যা… মাতা সুমিত্রা…। তুই ঠিক খবর এনেছিস তো সেবন্তী?”

“হ্যাঁ দেবী। আপনি উতলা হবেন না। মাতা কৌশল্যা, মাতা সুমিত্রা নিশ্চয়ই আপনাকে সংবাদ প্রেরণ করবেন।”

“তুই আমাকে উত্তম বস্ত্রাভরণে সজ্জিত করে দে, সেবন্তী। শ্বশ্রূমাতারা নিশ্চয়ই আমাকে স্মরণ করবেন।”

 

 

ভূমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কঙ্কণ, কেয়ূর, বহুমূল্য রত্নহার। গৃহের প্রদীপ নির্বাপিতপ্রায়। রাজমাতা কৌশল্যা, সুমিত্রা প্রত্যুদ্গমন করতে গিয়েছেন। এমনকি রাজমাতা কৈকেয়ীও। অযোধ্যার রাজবধূদের প্রতুদ্গমনের প্রথা নেই।  দুঃখের দিনে যেমন, সুখের দিনেও তেমনই কোন সংবাদ কেউ প্রেরণ করেনি তাঁকে। অযোধ্যার এই উৎসবমুখর দিনেও তিনি বিস্মৃতির অন্তরালে। প্রায়ান্ধকার কক্ষের একলা ভূমিতলে লুটিয়ে কাঁদছেন ঊর্মিলা। উপেক্ষিতা!

 

………০………

ঋণ স্বীকারঃ-

রামায়ণম্‌- ভট্টপল্লী নিবাসী পণ্ডিতপ্রবর শ্রী পঞ্চানন তর্করত্নেন সম্পাদিতম্‌। শ্রী অভিজিৎ শীল সংগৃহিত। (বেণীমাধব শীল’স লাইব্রেরী)

অংকনঃ মধুমিতা ঘোষ

 

 

Leave a comment

Check Also

দর্পণে

দর্পণে – নির্মাল্য ঘরামী    

    -চল, আমি জোরের সঙ্গে বললাম, -ওসব একদম ভাবিস না। তোকে এতদিন পরে পাচ্ছি, …

ফয়সালা

ফয়সালা – নির্মাল্য ঘরামী

  -দেখুন স্যার। বলে সিকিউরিটি গার্ডটি বিজয়ীর দৃষ্টিতে মহাকুলসাহেবের দিকে তাকালো। তার হাতে ধরা ব্যাগটির …

রক্তগোলাপ/ মৌসুমী পাত্র/ পুণ্যতোয়া ধর

রক্তগোলাপ – মৌসুমী পাত্র

  একটা মোটা দড়ি থেকে পাশাপাশি ঝোলানো সারি সারি মৃতদেহ। ছাল ছাড়ানো। গত কদিন ধরেই …

যখন অন্ধকার হাতছানি দিল

যখন অন্ধকার হাতছানি দিল – নির্মাল্য ঘরামী

  আলোটা এবারে দপ করে নিভে গেল। -যাহ! ওর মুখ দিয়ে শব্দটা প্রতিবর্তক্রিয়ার মতন-ই বেরিয়ে …