Home / চেনা জায়গা অচেনা কথা / রং,তুলি, মন -লেখে তিন জন : ইন্দ্রানী ভট্টাচার্য্য

রং,তুলি, মন -লেখে তিন জন : ইন্দ্রানী ভট্টাচার্য্য

এ এক আজব গ্রাম যেখানে বাস করেন কিছু রঙিন মানুষ।তাদের কলজে ভরা গান আর তারা তুলিতে মেশান প্রাণ।তারা যখন কথা বলেন ছবিতে, তখন এক আকাশ রামধনু নেমে আসে মাটিতে। চোখে লেগে থাকে সুরের সুরমা। পেশায় তারা চিত্রকর কিন্তু আদতে জাদুকর।তারা তুলির টানে হারিয়ে যাওয়া মাটির গল্প বলেন ।তাতে লেগে থাকে তেঁতুল বিঁচি আর বেলের আঠার গন্ধ। তাদের ছবিতে পুরানের দেব-দেবীরা হয়ে ওঠেন ঘরের মানুষ, প্রাণের দোসর।এ গ্রামের বাঁকে বাঁকে চলতে চলতে চোখে পড়ে এমনি নানা চিত্র গাঁথা।অবাক হয়ে দেখি যখন তাদের কুসুম মাটি নিকোনো দেওয়ালে আঁচড় কাঁটে কল্পনা, তখন চিত্রকরের সাধের রানী মাছ অপরাজিতার নীলে শৃঙ্গার করে প্রস্তুত হয় বিয়ের জন্য।কাঁচা হলুদে আঁশ রাঙিয়ে মৎসরাজও আবদ্ধ হন বিবাহবন্ধনে| পট জুড়ে হাজির হওয়া রঙিন মাছের দলের সাথে বাসরের আনন্দ ভাগ করে নেয় গোটা গ্রাম। জাফরানি লাল আর বাদামি শালপাতা মোড়া সামিয়ানায় এই নয়াগ্রামে এইভাবেই বছরভর খেলা করে অকালবসন্ত।এখানে পটুয়াদের পট চির রঙিন প্রকৃতির রঙে। (যদিও এখনকার বহু শহুরে আধা-শহুরে মেলাতেই দেখা যায় চাহিদানুসারে স্বল্পমূল্যে যোগান দিতে, পটে ব্যবহৃত রঙের স্থায়িত্ব ও ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি করতে এবং বাজার ধরে রাখার জন্য এই অঞ্চলের পট-শিল্পীদের একপ্রকার বাধ্য হয়েই ভেষজ রঙের বদলে কৃত্রিম রং ব্যবহার করেন।প্রাণের ছোঁয়া তাতে একটু কম থাকলেও মনের খিদে মেটানোর জন্য সেগুলোও এবাজারে এককথায় অমূল্য। )

rang-tuli-mon
ছবি: চিরঞ্জীব মজুমদার

হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন।পলাশ বিছানো পথ ধরে আমরা এসেছি আজ পিংলা ব্লকের নয়াগ্রামে।এ এক সৃষ্টিছাড়া গাঁ।এখানে যিনি যতীন চিত্রকর তিনিই নাকি জামালুদ্দিন।যিনি গোফুরান বিবি তিনিই আবার গৌরী চিত্রকর।ধর্মীয় ভেদাভেদ নয় এখানে শিল্পের নিক্তিতেই বিচার হয় তাদের স্বাতন্ত্র্য।এই গ্রাম চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয় এদের পৃথিবী আমার আপনার থেকে কতটা আলাদা।এই গ্রাম সেলিম চিত্রকর, জনার্দন পটুয়ার গ্রাম।তথাকথিত সভ্য দুনিয়ার অসুখগুলো এখনো ছুঁতে পারেনি এদের। তবে সময় বড় অস্থির।ধর্মের আফিম দেদার বিকোচ্ছে বেড়াল তপস্বীদের ঝুলি থেকে।তাই ভয় হয় এদের দেখে, প্রশ্ন জাগে কতদিন চারপাশের নেশাতুর দুনিয়া থেকে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য এইভাবে ধরে রাখবে নয়াগ্রামের মানুষগুলো? সময়ই বলবে তা।আপাতত আমাদের সমাজের চৌকিদারদের একবার অন্তত এসে ঘুরে যাওয়া উচিত এই পল্লীসমাজ যারা আজও বিশ্বাস করে নামের ফেরে মানুষ ফেরে না, কেষ্ট আর খ্রীষ্টে কোনো তফাৎ নেই।এই সম্প্রদায়ে একই পরিবারে এখনো স্বচ্ছন্দে মৃতের ইচ্ছে অনুযায়ী কাউকে মৃত্যুর পর সমাধিস্থ করা হয় আবার কেউ পান চিতার আগুন।বিয়েতে যেমন হিন্দু রীতি মোতাবেক গায়ে হলুদ,সিঁদুরদান বা শাঁখা পরানো হয় তেমনই বিবাহবাসরে মৌলবী এসে কলমা পরিয়ে যান। বিয়ের পর নব-দম্পতি একদিকে যেমন গাঁয়ের দেব-দেবীর থানে প্রণাম জানাতে যায় তেমনি সন্তানের অন্নপ্রাশনের দিন পালিত হয় সুন্নত প্রথা।এই গ্রাম বিশ্বাস করে লোকায়ত ধর্মে যা সংকীর্ণ ধর্মীয় বেড়াজালের উর্ধে উঠে মানুষের কথা বলে।এখানে ধর্মের কথা উঠলেই চিত্রকরের দল গেয়ে ওঠে -হাবিল পড়িল শাস্ত্র কাবিল কোরান / তাহা হতে সৃষ্টি হল হিন্দু মুসলমান।আমার মনে হয় দুই সহোদর ভাই হাবিল আর কাবিলকে নিয়ে এই দু’কলি গানই যথেষ্ট তাদের ধর্মীয় চেতনার স্বরূপ উপলব্ধির জন্য।বর্তমানে প্রায় আড়াইশো পটুয়া পরিবারের বাস এখানে| যুগ যুগ ধরে এখানে মাঠের ফসল, নদীর জল , ধর্ম-বিশ্বাস হাত ধরাধরি করে আপন খেয়ালে গড়ে উঠেছে , মানুষকে বাঁচতে শিখিয়েছে, মুখে দিয়েছে গান, প্রাণে দিয়েছে সুর আর হাতে দিয়েছে রঙিন স্বপ্ন।
ইতিহাস বলে চিরকালই সমাজের মূলস্রোতের বাইরে বেড়ে ওঠা এমন মুক্তমনা ধর্মীয় চেতনাকে সহ্য করতে হয়েছে সমাজ শাসকদের ভ্রুকুটি ও তাচ্ছিল্য।আদি –মধ্যযুগীয় সমাজও এর ব্যতিক্রম নয়। তুর্কো-আফগান যুগে যখন ভক্তি আর সুফিবাদ ধীরে ধীরে জায়গা করে নিচ্ছিলো সমাজের সকল স্তরে তখন ধর্মকে ঢাল করে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন তৎকালীন ব্রাহ্মণ্যধর্মের রক্ষকগণ।পটুয়াদের মতো এমন ‘দুরাচারী ম্লেচ্ছ সম্প্রদায়’কে সমাজে অন্ত্যজশ্রেণী হিসেবে প্রতিপন্ন করার জন্য প্যাঁচ কষতে থাকেন তারা। তাদের বক্তব্যের অভ্রান্ততা প্রমানের জন্য হাতিয়ার করেন সমসাময়িক যুগে রচিত বিভিন্ন পুরান ও ন্যয়শাস্ত্র।তেমনই একটি হলো ব্রহ্মবৈবর্ত্য পুরান।সেখানে বলা হয়েছে পুরাননির্দিষ্ট বিধি লঙ্ঘন করে ছবি আঁকার জন্য চিত্রকরগণ মহাদেব শিবের কোপানলে পড়েন এবং জাতিচ্যুত হয়ে না হিন্দু-না মুসলমান হয়ে সমাজে বাস করতে থাকেন।কিন্তু উচ্চবর্ণের এই ধরণের কোনো অবহেলাই স্পর্শ করতে পারেনি তাঁদের জীবনবোধ বা ধর্মীয় চেতনাকে।মজার ব্যাপার হলো বিভিন্ন সময়ে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে যেমন হিন্দু মুসলমান দুই সম্প্রদায়ই এদের শিল্পচর্চাকে নিজেদের ধর্মের মাহাত্ম্য বর্ণনায় ব্যবহার করেছিল তেমনি আবার ৪৬এর দাঙ্গার সময় উভয় সম্প্রদায়ের দ্বারাই এই পটুয়া সমাজ অত্যাচারিত ও নিগৃহিত হয়েছিল।
যাই হোক।ফিরে আসি আজকের কথায়।রাঙা মাটির পথ ধরে চলতে চলতে বারবার মনে হচ্ছিলো এই গ্রাম যেন কোনো নামজাদা শিল্পীর আর্ট গ্যালারি।পট বা কাপড়ের চৌখুপি ছাড়িয়ে গরুর গাড়ির চাকা, পালকি, নিকোনো আঙিনা এমনকি কুটির প্রাচীরেও খেলা করছে রঙিন ফুল,পাখি,মাছেদের দল।। মাঘের শেষ বিকেলে ঘুরতে ঘুরতে আলাপ হলো এই গ্রামেরই এক পটুয়া পরিবারের সাথে।তাদের শীতল পাটি বিছানো দাওয়ায় বসে জমে উঠেছিল গল্প । সাথে ছিল চা ,বাড়িতে ভাজা সজনে ফুলের বড়া আর জামবাটি ভর্তি মুড়ি।
পরিবারের কর্তাটির নাম ধরে নিন আনোয়ার।বয়স ওই আমাদেরই মতো হবে। সামনে মেলে রাখা খড়ি আর নীল মেশানো একফালি সাদা পট। তাতে ধীরে ধীরে লাগছে রঙের ছোঁয়া আর সেই সাথে আকাশের দিগন্ত জুড়ে ছড়িয়ে থাকা আবির যেন তুলির ডগায় নেমে আলতো করে ছুঁয়ে যাচ্ছে পটটিকে। ছবি আঁকার ফাঁকে ফাঁকে আনোয়ার বুঝিয়ে দিচ্ছিলো পট আঁকার নানা খুঁটিনাটি।
এই অঞ্চলের পটুয়ারা পট আঁকার কাজটিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে সম্পন্ন করেন।আবার এই প্রত্যেকটি ভাগের কিন্তু বেশ মজার কিছু নাম রয়েছে যেমন টিকলাম বা প্রাথমিক পর্যায়ের স্কেচ।পটের ওপর একমনে রং চড়াতে চড়াতে আনোয়ার ভাই জানালো যে স্থানীয় ভাষায় একে বলে পেহলি রাঙ্গাভরা বা বর্ণ মাখানো। এটি আঁকার দ্বিতীয় ধাপ।এর পর এই রঙিন জমিতে স্বপ্ন বুনবে শিল্পীর কল্পনার ফসল।। ধীরে ধীরে ফুটে উঠবে নানা রূপের পটচিত্র।আমি অবাক বিস্ময়ে দেখতে লাগলাম আর স্রষ্টা ক্রমে মেতে উঠলেন সৃষ্টি সুখের উল্লাসে।কিছু সময়ের মধ্যেই নির্দিষ্ট অংশে ফুটে উঠলো একটি আদিবাসী সমাজের খন্ডচিত্র।তারপর ছবিটি লণ্ঠনের কালী আর খড়পোড়া ছাই মিশিয়ে তৈরী কালো রেখায় স্পষ্ট করে ফুটিয়ে তোলা হলো। একে বলা হয় চোখ করা। ধামসা-মাদল সহযোগে আদিবাসীদের নৃত্যানুষ্ঠানের এতো জীবন্ত অনাড়ম্বর সাবলীল ছবি মনকে যেন মুহূর্তে পরিযায়ী করে তোলে।সবশেষে ছবির পাড়জুড়ে বসলো নানা রঙের ফুল-পাখির মেলা।সম্পূর্ণ হলো ছবি। পাড় আঁকার কাজ শেষ করে আনোয়ার হাত ধুঁয়ে বসলেন নামাজ পড়তে।চারপাশে ছড়ানো ছোট ছোট নারকেলের খুঁড়িতে রাখা অবশিষ্ট সিম আর নিম পাতার রস নিড়ানো সবুজ রং , কালো পোড়া চাল ভাজা, পাকা তেলাকুচা ফল চেঁপা লাল রং ,পাকা টেপিফল আর আর ঘুসুঙটি মাটি মেশানো নীল রং, পুইঁ মেচুরির বেগুনি রস,খয়ের আর এলামাটি মেশানো খয়েরি রং,এঁটেল মাটির রস, ভুরি-সিঁদুর,আলতা, হরিতাল ,গন্ধক আর তুঁতে।বাঁশের চোঙাতে সদ্য পরিষ্কার করে রাখা গরুর কানের লোম, ছাগলের লোম, বেজী আর কাঠবেড়ালির লোমে তৈরী দু-চারটি ভিন্ন মাপের তুলি।সদ্য-সমাপ্ত পটটি শুকোনোর জন্য ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে একপাশে।এই ছবিতে নেই কোনো রাজসিক আভিজাত্য, নেই নাগরিক বা বিমূর্ত-ভাবনার প্রকাশ,নেই কোনো অলংকরণের বাহুল্য।এ ছবি একেবারেই শিশুসুলভ সারল্যে ভরপুর।আছে তাতে শুধু প্রাণের উল্লাস।এই প্রসঙ্গে মনে পরে যায় বাংলার পট সম্পর্কে বাংলার লোকচিত্র সংগ্রাহক ও গুণগ্রাহী গুরুসদয় দত্তের কথাটি। তিনি বলেছিলেন-“এই সকল চিত্রপটে একদিকে পুরুষদেহের বীরোচিত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ও ভাবভঙ্গীর অঙ্কনপ্রণালী ও অপরদিকে নারীদেহের লীলায়িত রূপ-লাবণ্যমাধুরীর বিচিত্র অঙ্কন কৌশলের স্বভাবজাত সমাবেশ দেখিয়া অবাক হইতে হয়। অনুকরণমূলক অঙ্কনবাহুল্য বর্জন করিয়া ইঙ্গিতে ভাবের ও রসের পরিপূর্ণ ব্যঞ্জনাসক্তি এই সকল চিত্রপটের একটি বিশিষ্ট লক্ষণ।….চিত্রে অতি-পরিস্ফুট ভাবে কাহিনী বিবৃত করিবার অসাধারণ ক্ষমতা এই চিত্রকলা পদ্ধতি ভারতের আদিম যুগ হইতে পূর্ণ ভাবে বজায় রাখিয়া আসিতে সমর্থ হইয়াছে।”

আলো পড়ে এসেছে।মোমবাতির চাপা আলোয় কেমন যেন রহস্যময় হয়ে উঠেছে চারিদিক।অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে কীর্তনের সুর।তুলসী তলায় বাতি দিয়ে মা লক্ষ্মীর পুজো সেরে আমাদের সাথে যোগ দিলেন আনোয়ার বাবুর স্ত্রী মহুয়াও। আমরা দেখবো বলে নিয়ে এসেছিলেন বেশ কিছু তাঁদের হাতে আঁকা পট। এক একটি পট যেন এক একটি সচিত্র গল্প।দেখলাম রামায়ণ-মহাভারত বা পুরানের নানা কাহিনী,হিন্দু দেব-দেবীর মাহাত্ম্যবর্ণনের পাশাপাশি পটচিত্রে জায়গা করে নিয়েছে মঙ্গল কাব্যের নানা চরিত্র,বৌদ্ধ, খ্রিস্টীয় এবং মুসলিম ধর্মবিশ্বাস, দিন-বদলের কাহিনী,স্থানীয় লৌকিক আচার-বিশ্বাস এবং নানান কিংবদন্তি। সত্যিই তো , ভারতীয় সংস্কৃতির মূলধারা এভাবেইতো জারিত হয়েছে স্থানীয় লৌকিক , উপজাতি সংস্কৃতির স্পর্শে যুগ যুগ ধরে।উভয়ের এই অনাবিল সমন্বয় সমৃদ্ধ করেছে আমাদের দেশ তথা বাংলার ঐতিহ্য ও কৃষ্টির বহমান ধারাকে।

আমাদের মূল আগ্রহ ছিল ছবিতে দেখানো মাছের বিয়ে বা আদিবাসী নৃত্য সম্পর্কিত মজার মজার গল্পগুলোর প্রতি।সেই মোতাবেক বায়না ধরলাম গল্প শোনার জন্য।কিন্তু এ গল্প তো আর যে সে গল্প নয়। খাঁটি দুধে ভিজিয়ে রাখা নরম তুলতুলে আমসত্ত্বের মতোই লোকসঙ্গীতের সুরে সুরে মিশে থাকা গ্রামবাংলার মাটির গল্প।মহুয়া দিদি বড় যত্ন করে শোনালেন সেই কাহিনী-ঠাকুর দেওয়া বা ভূমিকা কথন থেকে শুরু করে মূলবিষয় এবং সবশেষে পালা দেওয়া বা স্তুতিকীর্তন এবং আত্ম পরিচয় জ্ঞাপন, বাদ দিলেন না কিছুই। সেই গানের যেটুকু আমার দুর্বল স্মৃতিতে ধরে রাখা ছিল তারই দু-চার কলি রইলো নিচে –

দাঁড়িয়া মাছের বিয়ে করাতে চলো গো রঙ্গিলা
কই মাছ বলছে দেখো কানের পানছড়া হবো গো রঙ্গিলা
পাবদা ভেটকি বলছে দেখো তোমার হাতের চুড়ি হবো গো রঙ্গিলা
চিংড়া মাছ বলছে দেখো তোমার বিয়ের ঢোলক বাজাইবো গো রঙ্গিলা
ভেটকি শিং বলছে দেখো তোমার নাকের নদ হবো গো রঙ্গিলা
মৈরোলা মাছ বলছে দেখো তোমার বিয়ের ডুলিন হইয়া যাবো গো রঙ্গিলা
ভোলা মাছ বলছে দেখো তোমার মিষ্টির হাঁড়ি লইয়া যাবো গো রঙ্গিলা
চিংড়া মাছ বলছে দেখো তোমার বিয়ের হারমোনিয়াম বাজাইবো গো রঙ্গিলা
পুঁটি মাছ বলছে দেখো তোমার মাথার টিকা হবো গো রঙ্গিলা
বুয়াল মাছ বলছে দেখো ব্যাটা সব শালারে খাবো গো রঙ্গিলা
দাঁড়িয়া মাছের বিয়ে করাতে চলো গো রঙ্গিলা

গান শেষ হলো সেই সাথে গল্পও। গল্পের শেষটা এমন করুন না হলেই হয়তো ভালো হতো । কিন্তু ওই যে বললাম এ গানের ভাষা হলো প্রাণের ভাষা। মন ভোলানো চমক-ঠমক এতে নেই। নেই ভাষার মার্-প্যাঁচ। শুধু তাদের সহজ-সরল অনাড়ম্বর জীবনের অভিজ্ঞতার নকশা দিয়ে সাজানো এক গীতিআলেখ্য। অথচ ভেবে দেখুন এই গল্পের মোড়কে কি কঠিন বাস্তবকেই না তুলে ধরেছেন তারা। আমাদের চারপাশের দুনিয়া তো এমনি।কিছু মানুষের ভেকধারী ভালোমানুষি নিজেদের অজান্তে কতই না আঘাত হানে রোজকার জীবনে। আমাদের ছোট ছোট ভালোলাগা -ভালোবাসায় সাজানো বাগান এভাবেই তো বারবার গুড়িয়ে যায় অন্য কারুর অন্যায় হঠকারিতা,পেশী-আস্ফালনে।

আনোয়ারের বাড়িতেই কেটে গেলো আমাদের আজকের রাত। চিত্রকর পরিবারটির এমন আতিথেয়তা উপেক্ষা করার ক্ষমতা আমার ছিল না।তাদের মুখেই শুনলাম তাদের শিকড়ের গল্প।সেই সাথে এমন অরূপ রতনের উৎস সন্ধানে নয়াগ্রাম থেকে ফিরে আসার পর আলাদীনের চিরাগ হয়ে উঠেছিল মেদিনীপুর জেলা গ্রন্থাগার।

হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ মোতাবেক পট কথাটির চার ধরণের ব্যখ্যা পাওয়া যায়- বস্ত্র, লেখা বা ছবি আঁকার জন্য কার্পাস বস্ত্র ,ছবি আঁকার জন্য কাঠের পট্ট এবং চিত্রপট।আবার পট অর্থে কোথাও কোথাও পাট্টা বা রাজকীয় সনদ (মেদিনীকোষ অনুসারে), তাম্রফলকে খোদিত অনুশাসনকেও বোঝানো হয়েছে। তবে কালে কালে পট ব্যাপারটি পাট বা রেশম বস্ত্রের সমার্থক হয়ে ওঠে ।অনেক বিজ্ঞজনই নাকি তাদের এই শিল্পশৈলীর সঙ্গে হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো এমনকি অজন্তার গুহাচিত্রশৈলীর মিল খুঁজে পেয়েছেন। আবার আড়াই হাজার বছর আগের সাহিত্যেও এই পটুয়া, চিত্রকরদের উল্লেখ পাওয়া যায়।প্রাচীন সূত্র থেকে জানা যায় খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ব্রাহ্মণ্য বিরোধী প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলনের দিকপালপুরুষ গোশালমঙ্গলিপুত্ত নিজে ছিলেন একজন পটচিত্রকর। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে অষ্টাধ্যয়ী কাব্যে পানিনি এই ধরণের চিত্রকরদের গ্রামশিল্পী এবং রাজশিল্পী এই দুটি গোষ্ঠীতে ভাগ করেছিলেন। পরবর্তী কালে পতঞ্জলির মহাভাষ্যে শৌভিক নামে চিত্রগোষ্ঠীর উল্লেখ পাওয়া যায় যারা পথে প্রান্তরে তাঁদের আঁকা পথের সাহায্যে কংসবধ পালা উপস্থাপনা করতো।বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের প্রাচীন গ্রন্থাদিতেও যেমন জাতক,সংযুক্তনিকায় ,খণ্ডসংযুক্ত,অশ্বঘোষের বুদ্ধচরিতেও বিক্ষিপ্ত ভাবে বিভিন্ন প্রসঙ্গে পটের উল্লেখ আছে। পটশিল্পের প্রবহমান ধারা পরবর্তী যুগেও ভারতীয় সংস্কৃতিকে একই ভাবে পুষ্ট করেছিল। খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকে মহাকবি কালিদাস বিরোচিত অভিজ্ঞানশকুন্তলম ,মালবিকাগ্নিমিত্রম নাটক , সপ্তম শতকে বাণভট্ট রচিত হর্ষচরিতে এর উল্লেখ মেলে। অষ্টম শতকে রচিত মুদ্রারাক্ষস নাটকে নাট্যকার বিশাখদত্ত চিত্রকরদের গুপ্তসংবাদসংগ্রাহক ও বাহক হিসেবে তুলে ধরেছেন।সমসাময়িক ব্যক্তিত্ব ভবভূতিও তার উত্তররামচরিত গ্রন্থে দীঘল চিত্রপ্রদর্শনের উল্লেখ করেছেন যেটি আসলে ছিল দীঘলপট বা জড়ানো পট।ত্রয়োদশ শতকে রচিত ব্রহ্মবৈবর্ত পুরানে নবশাক বা নবশান গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হিসেবে পটুয়াদের উল্লেখ আছে।এছাড়া চর্যাপদ, পরাশরস্মৃতি, রূপ গোস্বামীর বিদগ্ধমাধব,গোপাল ভট্টের হরিভক্তি বিলাস প্রভৃতি সাহিত্যও আমাদের মধ্যযুগ জুড়ে বিভিন্ন কালপর্বে পটুয়াদের অস্তিত্ব ও বিকাশের কথা জানতে সাহায্য করে।তুর্ক-আফগান যুগে হিন্দুবর্ণের তথাকথিত নিম্নবর্ণ ও অন্ত্যজ শ্রেণীর সামনে সমন্বয়বাদী ভক্তি আন্দোলনের জোয়ার এনেছিল গৌরীয় বৈষ্ণবধর্ম। সেই জোয়ারে স্নাত হয়েছিল বাংলার পটচিত্রশিল্পও। উচ্চবর্ণের পৃষ্ঠপোষকতা না পেলেও জনপ্রিয়তায় হার মানিয়েছিল অন্যান্য প্রতিষ্ঠিত শিল্পকলাকে।পরবর্তীকালে সাঁওতাল,হোস ,মুন্ডা, খেড়িয়া প্রভৃতি আদিবাসী সম্প্রদায়ের জীবন-চর্চায় নতুন ভাবে এই শিল্প প্রাণ খুঁজে পায়। আদিবাসীদের বিশ্বাসমতে এই পৃথিবীর আদিপুরুষ পিলচু হারাম আর আদিমানবী পিলচু বুড়ির গল্প বলার জন্য তারা আশ্রয় নেয় পটচিত্রের।এই কাহিনী মোতাবেক পিলচু হারাম এবং পিলচু বুড়ির সাতটি পুত্র এবং কন্যা সন্তানের জন্ম হয় এবং তাদের পরস্পরের মধ্যে পরিণয়ের মাধ্যমে পৃথিবীতে আসেন তাদের বংশধরেরা।এরাই আদিবাসী পরম্পরা অনুসারে মানুষের পূর্বপুরুষ। আমরা সবাই কম-বেশি আদম-ইভের গল্প শুনেছি কিন্তু এই দুই চরিত্রকে আমরা চিনি কজন? আমাদের দেশের মাটিতে লোকচক্ষুর অন্তরালে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসা এই দুই লৌকিক চরিত্রকে সযত্নে বাঁচিয়ে রেখেছেন পটুয়া-চিত্রকরের দল তাদের আঁকা পটচিত্রে।যামিনী রায় তাইতো বলেছিলেন-“পৃথিবীর প্রায় বাকি সব জায়গাতেই প্রাগৈতিহাসিক ছবি লুপ্ত হয়ে গেছে, পটুয়া ছবি সম্পূর্ণ মরেনি।”

পট সাধারণত তিন ধরণের হয়-দীঘল পট বা জড়ানো পট , চৌকো পট এবং কালিঘাটের সরাপট বা গোলাকৃতি পট।নয়াগ্রামে এসে আমরা মূলত দীঘলপটই দেখেছি।দীঘল পট বা জড়ানো পটে আঁকা ছবির গল্পই গান সহযোগে পরিবেশিত হয় ঠিক যেমনটি আগে মাছের বিয়ের গল্প বললাম।দীঘল পটকে আবার বিষয় বৈচিত্র অনুসারে কয়েকটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়-পৌরাণিক পট(বিষয় – পুরান, মহাকাব্য ও লোকগাঁথা , যেমন সীতাহরণ পালা বা শ্রী-কৃষ্ণলীলা), যম পট(যমরাজের বিচারসভা প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে নীতিশিক্ষা প্রদান Iঅনেক সময়ই স্থানীয় লৌকিক বিশ্বাস অনুসারে যমের ভূমিকা পালন করে থাকেন মারাং বুরু এবং তার শাস্তির চরিত্রও দেখা যায় বেশ ভয়াবহ), সাহেব পট(মূলত ইংরেজদের জীবনযাত্রা যেমন ইংরেজ সাহেবের বাঘ শিকার ও খ্রিস্টের মহিমা বর্ণন,আড়-লাটাই পটে চিত্রিত জমিদার-দেশনেতাদের কাহিনী),গাজীর পট(পীর বা গাজীর বন্দনা যেমন রসুলপুরে পীর সাহেব তাজ খান মসনদ-ই-আলার মহিমাকীর্তন),আদি পট(সাঁওতাল,আদিবাসী ও উপজাতি সম্প্রদায়ের উৎসকাহিনী যা পূর্বেই আলোচনা করেছি),জাদু পট বা চক্ষুদান পট (আয়তাকার বা বর্গাকার পটে মূলত আদিবাসী সমাজে মৃত ব্যক্তির স্মৃতির উদ্দেশ্যে আঁকা প্রতিকৃতি। পুনর্জন্মের মতো বিষয়ও কখনো কখনো এতে স্থান পায়।),পঞ্চকল্যানী পট(একাধিক দেব-দেবীর একত্রে বন্দনা),গোঁসাই পট (সাধু সন্তদের নিয়ে রচিত), রূপকথামূলক পট , বেড়াপট বা মঙ্গলপট (শিকারে সাফল্য লাভের উদ্দেশ্যে দেবতার ছবি এঁকে বন্দনা), পৌরিপট (যাত্রা শুরুর পূর্বে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন), মরা-হাজা পট (জঙ্গলে কেউ হারিয়ে গেলে আদিবাসী বিশ্বাসমতে মারাংবুরুর ইচ্ছানুক্রমে পটে হারিয়ে যাওয়া ব্যক্তির অবস্থা কল্পনা করে চিত্র অঙ্কন ),এবং সামাজিক পট বা আধুনিক (সমসাময়িক বিষয়বস্তু সংক্রান্ত)পট।এই পটের মধ্যে দিয়েই পটুয়ারা বিলিয়ে দেন-জ্ঞান,শিক্ষা ,আনন্দ ও পুন্য।
ঔপনিবেশিক শাসনকালে স্বার্থান্বেষী ইংরেজদের হাত ধরে বহু প্রাচীন মূল্যবান পটই অন্যান্য অনেক মহার্ঘ সামগ্রীর মতো দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে ইংল্যান্ডসহ ইউরোপের নানা দেশে স্থানান্তরিত হয়ে গেছে।মেদিনীপুর জেলা পটচিত্রও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে চিত্রকরদের দক্ষতার গুনে বিভিন্ন বৈচিত্রের সব ধরণের পটচিত্রের নমুনাই এখনো পাওয়া যায় এখানে।
এই প্রসঙ্গে বলে রাখা প্রয়োজন বাংলা তথা ভারতবর্ষকে পরাধীনতার গ্লানিমুক্ত করতে সমাজের অন্যান্য শ্রেণীর ন্যয় জীবনকে বাজি রেখেছিলেন এই অঞ্চলের পটিদার বা চিত্রকর শ্রেণীও। তারা পটের গানে তুলে ধরেছিলেন চুয়াড় বিদ্রোহ, আদিবাসী বিদ্রোহ,ক্ষুদিরাম-প্রফুল্ল চাকির কথা I আনোয়ারের মুখে শোনা তার পূর্বপুরুষদের বীরগাঁথা ছাড়াও এই বিষয়ে আমাকে আলোকপাত করতে সাহায্য করেছিল ডেভিড ডি ম্যাকাচ্চন লিখিত প্রামাণ্য গ্রন্থ The Patua and the Patua Songs of Bengal. জানা যায় ৪২ এর আন্দোলন চলাকালীন জোর করে বন্ধ করে দেওয়া হয় সাহেবপট আঁকা এবং হুলিয়া জারি করা হয় যারা এই পট লোকসমক্ষে প্রদর্শন করবে তাদের কপালে নেমে আসবে কঠিন শাস্তির খাঁড়া।পটুয়ারা বাধ্য হয় পটের গান বন্ধ করতে। লুকিয়ে ফেলে সব পট। ব্রিটিশদের চোখে ধুলো দিতে পাল্টে ফেলে গানের ভাষাও।
এই অগ্নিযুগে লেখা একটি পটের গান সেই সময় লোকের মুখে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল গান্ধীজির গান নামে। আনোয়ার বাপ্-ঠাকুরদার মুখে শুনেছিলো সেই গান আর আজ আমরা তার মুখে শুনে ধন্য হলাম।নিচে দিলাম এই গানেরই কিছু কথা –

সত্যি কথা বললে বিপদ আছে ভাই
লাঠি হাতে দারোগা ধরবে এসে তাই
ভাত নাই, কাপড় নাইকো ঘরে ঘরে
মেয়েছেলে সবার ঘরেতে কেঁদে মরে।
এই হলো গ্রামের খবর দিন রাতে ,
চলো যাই স্বরাজের ডাকে এক সাথে।
জেল থেকে ডাকিছে গান্ধীজি আমাদের
স্বরাজ আসিবে ভাই আর নেই দের

মেদিনীপুরে এক সময়ে চাষি গৃহস্থদের ধান ওঠার মরসুমে পটুয়া, চিত্রকরের দল বাড়ি বাড়ি ঘুরে গান সহযোগে পট দেখিয়ে বেড়াতেন। স্বভাবতই পটচিত্র হয়ে উঠেছিল লোকমুখী। গৃহস্থরা মনোরঞ্জনের বিনিময়ে পটুয়াদের হাতে তুলে দিতেন কখনো নগদ পয়সা , কখনো বা চাল-তরিতরকারি কখনোবা সামর্থ্যমতো ধান। বর্তমানে এই পটুয়া বা চিত্রকরদের অনেকেই ভিড় জমান রাজ্যজুড়ে বছরভর চলতে থাকা বিভিন্ন মেলাগুলিতে। এদের মধ্যে কয়েকজন নিজ প্রতিভা আর শিল্পের কদরের জোরে রাজ্যের গন্ডি ছাড়িয়ে পাড়ি জমিয়েছেন ভিনরাজ্যে বা কখনো ভিন দেশে। পিংলায় প্রতিবছর আয়োজিত পটমায়া উৎসবে অংশ নেওয়ার জন্য সারা বছর ধরে মুখিয়ে থাকেন এই পটুয়া বা চিত্রকর পরিবারগুলি। ঢেলে সাজান তাদের পসরা। পৃথিবীর নানা জায়গা থেকে পর্যটকদের ঢল নামে নয়াতে।আর হ্যাঁ এখন শুধু পট নয় তাদের শিল্পের ছোয়াঁতে নতুন ভাবে সেজে উঠছে টি-শার্ট থেকে শুরু করে ফুলদানি অব্দি, সাবেক তালপাতার পাখা থেকে শুরু করে ছাতা অব্দি। আধুনিক অন্দরসজ্জায় পটচিত্রের ব্যবহার কিন্তু আপনার বাড়ির ভোল পাল্টে দিতে পারে।তাই দেরি না করে আপনারাও আসুন সপরিবারে।বছরভর এমন রঙিন বসন্তের দেশ খুব কমই আছে আজকের পৃথিবীতে।

Leave a comment

Check Also

la-jabab-babrasha

লা জবাব বাবরসা -ইন্দ্রানী ভট্টাচার্য্য

আমার অনেকদিনের শখ আজ পূরণ হলো। ব্যাপারটা এরকম। আজ অফিস থেকে বেরোনোর সময় আমার অফিসতুতো …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *